কবিতার পরিবারের একমাত্র ব্লগজিন

এখনও পর্যন্ত  Website counter  জন ব্লগটি দেখেছেন।

শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

মৌ দাশগুপ্তা

নীড় ছোট, ক্ষতি নেই

কবিবন্ধু নীল আর ওর বউ আঁখির একান্ত অনুরোধে অনেকদিন পরে শ্রাবনমাসের রবিবারের সকালটাকে চোখ মেলে দেখতে দেখতে চলেছি কলকাতা শহর ছাড়িয়ে শহরতলীর পথে। প্রবাসী চোখে যাচাই করছি কতটা পালটে গেছে আমার চিরচেনা শহরের পটভূমি!

নীল আর আঁখি দুজনেই আমার ছোটবেলার বন্ধু, একপাড়াতেই বড় হওয়া, স্কুল
থেকে কলেজে যাওয়া, বৈবাহিক সূ্ত্রে বাংলার বাইরে থাকলেও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের বদাণ্যতায় যোগাযোগে ভাঁটা পড়েনি। নীলের খুব ছোটবেলাতেই বাবা মা মারা যাবার কারণে ও ওর ঠাকুরদার কাছেই বড় হয়েছে। রুদ্রদাদু আমাদেরও খুব আপনজন.আজ সেই রুদ্রদাদুর পারলৌকিক কাজ উপলক্ষ্যেই যাচ্ছি। যতটা না রুদ্রদাদুর টানে,তার থেকে অনেক বেশী নীল,আঁখির মত ছোটবেলার বন্ধুদের টানে,পিছে ফেলে আসা বাল্যকালের সেই গাছপালা,পুকুরঘাট,স্কুলবাড়ী,খেলার মাঠ,ঝোপ জঙ্গল,মেঠোপথ,রাস্তাঘাটের টানে। অবশ্য মিথ্যে বলব না, ঠিক এই সময়েই হঠাৎ করে কলকাতায় সপ্তাহখানেকের একটা অফিসিয়াল ট্যুর পেয়ে যাওয়ায় আসার তাগিদটাও জোরালো হয়েছে। তার জন্য অবশ্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি,তবে সে প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। নীল ওদের বসতবাড়ীটা এক  সংস্থাকে
দান করে দিয়েছে, রুদ্রদাদুর কাজের দিনই ওখানে ওই  সংস্থা তাদের নতুন একটি বৃদ্ধাশ্রম শাখার উদ্বোধন করছে, “নীড়”। সে অনুষ্ঠান দেখার আগ্রহটাও ষোলোআনা আছে।।

যাবার পরে বুঝলাম, না আসলে সত্যিই অনেক কিছু মিস করতাম, অনেককে মিস
করতাম। আমার এখন আসা হয় কালেভদ্রে, কারো সাথেই সেভাবে দেখা সাক্ষাৎ হয়ে ওঠেনা, এবার একজায়গায় একসাথে অনেককে পেয়ে গেলাম। পুরানো বন্ধু, পুরানো পাড়ার মামা-মামী, কাকা কাকী, দাদা-বৌদি, দিদি-জাম্বুদের,অনেক নতুন মুখও দেখলাম। বেশ লাগছিল।

এক প্রাক্তন শিক্ষিকার সাথে দেখা হল, অবসরের পরে সমাজসেবা নিয়ে ব্যস্ত
আছেন শুনলাম। প্রনাম করে কুশল বিনিময়ের পর জানতে চাইলাম - অবসর জীবন কেমন কাটছে ।
উত্তরে তিনি জানালেন-
- ভালই, তবে খুব ব্যস্ত।
- কি নিয়ে?
- এই নিন্দা জ্ঞাপন, শোকজ্ঞাপন ও অভিনন্দন জানানো নিয়ে
- মানে?
- কেউ খারাপ কিছু করলে তার জন্য নিন্দা জ্ঞাপন, কেউ মারা গেলে তার জন্য শোক জ্ঞাপন আর কেউ ভাল কিছু করলে তাকে অভিনন্দন জানানো।
- এতে আসলে কি হয়, বুঝতে পারছি না, দয়া করে একটু যদি বিষয়টা পরিস্কার করে বলতেন!!
- আমি যে এখনও আছি এটা জনগণকে জানানো মানে জনগনের সাথে ক্লোজ কন্ট্যাক্টে থাকা আর কি।
আর কথা বাড়ালাম না, বুঝলাম পরিবর্তন সব জায়গাতেই ছায়া ফেলছে। হঠাৎই মনে পড়ল আমাদের স্কুলের বড়দিদিমনির কথা, বিখ্যাত বিপ্লবী সতীশ সেনের ভাগ্নী, সেই সময়কার ট্রিপল এম.এ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার গায়েত্রী সেনগুপ্তার কথা।বেঁচে থাকলে এই পরিবর্তন কি গায়েত্রী দিদিমনির ওপরও এভাবে ছায়া ফেলত?

বেশ কাটলো সারাদিন, সেদিন আর ফেরা হোল না, ঠিক করলাম পরদিন একটু ঘুরে
ফিরে এর -তার সাথে দেখা করার কাজটা সেরে নেব। আঁখি বললো সারাদিন সঙ্গ দেবে। সুবিধাই হোল। রাতে খেতে বসে নীলই প্রথম প্রসঙ্গটা তুললো। ও নীড়ের ট্রাস্টিবোর্ডের মেম্বার, নীড়ে দু’টো সীট আছে যে দু’টো স্পনসরশীপের ওপর চলে। অনেকেই আছেন যাঁরা এই সংস্থায় মাসিক আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকেন। আর্থিক সঙ্গতি আছে এমন চেনাশোনা সবার কাছেই খুব সামান্য অনুদান চাওয়া হয়। তারপরে কে দেবে আর কে দেবে না সে তাদের ব্যক্তিগত
সমস্যা। বললাম-
- আন্দাজ কি রকম দেয় লোকে?
মুখে ভাতের গ্রাস তুলতে গিয়ে হেসে ফেলে নীল বললো-
- তার কোন ঠিক আছে নাকি? ৫০ থেকে ৫০০, বেশী কম ও হয়, কতলোক তো দেব বলেও
দেয় না,কেউ এক দু’বার দিয়েই বন্ধ করে দেয়।ঠিক আছে নাকি?তোকেও জোর করছি না মিষ্টু, ইচ্ছা হলে দিবি, ইচ্ছা না হলে দিবি না, আর দিসই যদি কত দিবি সেটা তুই-ই ঠিক করবি, আমরা নাক গলাবো না।
আঁখি বললো-
- একটা কাজ করি মিষ্টু, আজ তো এখানে নীড়ের সবে উদ্বোধন হল, আবাসিকরা সবাই আসে নি। কাল চল তুই আর আমি বরঞ্চ ওদের নিমতা শাখাটা দেখে আসি। আগে কত ঘনঘন যেতাম, আজকাল নীলেরও সময় হয় না আর আমারও কলেজের ফাঁকে সময় পাই না। দাদুভাইয়ের অসুখটাও এমন সময়ে হল, দাদুভায়ের এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রথম ওখানে যাওয়া, এত ভালো লেগেছিল না রে মিষ্টু, রবিবার আসলেই মন টানতো। নিজের চোখে দেখার পরে নীড় সম্বন্ধে কিছুটা বেশী জানতে পারবি।

সাধু প্রস্তাব, কাল আমারও দারুন জরুরী কোন কাজ নেই, তো রাজী হয়ে
গেলাম। তা হলেও ঘুরে ফিরে কাজ মিটিয়ে নীড়ের নিমতা শাখায় পৌঁছতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে এল। দোষটা আমার নয়, আঁখি প্রায় মাস সাত আটেক পরে ওখানে যাচ্ছে বলে সবার নামে নামে খুটখাট ছোটমোট জিনিষ কেনাকাটি করেছে আর আমায় এ দোকান থেকে সে দোকান ঘুরিয়ে মেরেছে। আকাশ জুড়ে সেদিন জোৎস্নার ঢল নেমেছে, লোডশেডিং চলছিল বলে আরও ভালো লাগছিল জোৎস্নাটা। দেখতে দেখতে চাঁদ ছাপিয়ে উড়ে এল দামাল কালো মেঘ। চারপাশটা আরো অন্ধকার করে ঝেঁপে বৃষ্টি এল।

ছোট্ দোতলা বাড়ী, শান্ত পরিবেশ, অন্ধকারে বিশেষ কিছু আর দেখতে পেলাম
  না। ফিসঘরে একজন রোগা চেহারার হাসিমুখের ভদ্রমহিলা এমারজেন্সি লাইট জ্বেলে বসে ছিলেন। আঁখিকে যেভাবে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন, বুঝলাম, ভালোই চেনেন। এটাসেটা দু এটা কথা বলে আঁখি বললো,
- ওঠ মিষ্টু, সবার সাথে দেখা করে আসি।
বলে ওর সারপ্রাইজ গিফ্টভরা ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা দিল, পিছন পিছন আমিও। ওর তালিকা থেকে একজন মারা গেছেন, দু’জন আপাতত হসপিটালাইজড, একজনকে প্রবাসী মেয়ে এসে বাড়ী নিয়ে গেছেন। তিনজনকে শারিরীক কারনে অন্য শাখায় পাঠানো হয়েছে। দু’জন নতুন এসেছেন। ঘুরতে ফিরতে হাসিদি (আসল নামটা জানি না) খবরগুলো দিলেন। দুজনের একজন রয়েছেন সেই স্পনসরড সীটে, খুব অসুস্থ, বিনাচিকিৎসায় কোন এক সরকারী হাসপাতালের বারান্দায় ধুঁকছিলেন, সহৃদয় কেউ এখানে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। লম্বাটে একটেরে  ঘরে পরপর ছয়জনের থাকার ব্যাবস্থা। একদম দেওয়াল ঘেঁষে জানলার পাশের বেডটায় যিনি শুয়েছিলেন তাকে দেখিয়ে হাসিদি কথাগুলো বললেন। আমরা পাশে গিয়ে দাঁড়াতে খুব ক্ষীন কাঁপাকাঁপা স্বরে বললেন -
- যাও তো, জানালাটা খুলে মোমবাতিটা নিভিয়ে দাও। জ্যোৎস্না আসুক।”
- বড্ড বৃষ্টি বাইরে মাসীমা, আর মশাও ঢুকবে যে, -নরমভাবে হাসিদি বললেন।
-“জানালা দিয়ে এখন বৃষ্টি ভেঙ্গে নেমেছে লাগছে! সেটা আবার ঝপঝুপে শব্দের মাঝে! বড় অদ্ভুদ সে দৃশ্য। ভগবানের অমর সৃষ্টি, মানুষের আয়ূ আর কদিন? যা পারি দেখে নিই।”
সরে যাচ্ছিলাম, শুনতে পেলাম আপনমনে উনি বলছিলেন-
-“রোদের মাঝে যেমন বৃষ্টি নামে, তেমনি জ্যোৎস্নার মাঝে বৃষ্টি নামে নাকি? দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। এক সাথে বৃষ্টি আর বাঁধভাঙ্গা জ্যোৎস্না....এ জীবনে আর দেখা হল না।”
“এক সাথে বৃষ্টি আর বাঁধভাঙ্গা জ্যোৎস্না.”???? বড্ড চেনা কথাগুলো, কোথায় যেন শুনেছি, ঠিক মনে পড়ছিল না, বাইরে সজোরে বিদুৎ চমকালো, লাইটগুলোও জ্বলে উঠল। আমরা দুজন একসাথে পিছিয়ে এসে ঝুঁকে পড়লাম ভদ্রমহিলাকে ভালো করে দেখতে।
- প্রভা দিদিমনি? এ কি চেহারা হয়েছে আপনার?
স্কুলে আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষিকা ছিলেন এই প্রভা দিদিমনি । আমাদের কি সুন্দর করে যে বাংলা পড়াতেন, কঠিন প্রশ্নগুলোর উত্তর কি সরলভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে বাড়ী গিয়ে আর মানেবই পড়র দরকার পড়ত না। অথচ মাধ্যমিকের ঠিক আগে কাউকে কিছু না বলে কেন যে আসা বন্ধ করে দিলেন জানিনা। পরে কানাঘুষোয় শুনেছিলাম পারিবারিক কারণে নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়ীর লোকে ওনাকে মানসিক রুগীদের হাসপাতালে ভরতি করিয়েছিল এবং উনি সম্ভবত ওখান থেকে কোথাও চলে গেছিলেন। অবিবাহিত প্রভা দিদিমনিকে আমরা সবাই খুব মনে করতাম। পরে সময়ের সাথে তিনিও ধূসর পান্ডুলিপিতে ছবি হয়ে ছিলেন। আজ সেই পান্ডুলিপির ধূসর পাতা খানিকটা ধূলো উড়িয়ে জানান দিলো, যে, আমি আছি।আমরা চিনলেও উনি কিন্তু আমাদের চিনতে পারলেন না। ওনার স্মৃতি, ওনার
বোধ, ওনার চিন্তা, পারিপার্শ্বিকতা আর কোনদিনই বর্তমানে ফিরবে না।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফেরত এলাম। আঁখিকে বললাম, দিদিমনির খরচাটা আমিই
  দেবো। অন্য কারো কাছ থেকে নেবার দরকার নেই। আমার পক্ষে তো আর থাকা সম্ভব নয়, আমার হয়ে আঁখিই যেন যা যা করনীয় সেটা করে আমায় খবর দেয়।

আমি গুরুদক্ষিণা দেবো ভাবলেই তো হল না, হয়ত গুরুদক্ষিণা দেবার যোগ্যতাও
সবার থাকে না।অন্তত আমার হয়তো নেই, ফেরার পথে রাস্তাতেই মোবাইলে আঁখির থেকে শেষখবরটা পেয়ে গেলাম।

এবার থেকে আমি জোৎস্নারাতে বৃষ্টি নামলেই জানালা দিয়ে জ্যোৎস্নার মাঝে
টিপটিপ বৃষ্টি নামা দেখবো। কারন আমি জানি ভরা জ্যোৎস্নায় কোনো অপূর্ণতা থাকে না।
 
 

1 টি মন্তব্য: