কবিতার পরিবারের একমাত্র ব্লগজিন

এখনও পর্যন্ত  Website counter  জন ব্লগটি দেখেছেন।

শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

রত্নদীপা দে ঘোষ


এক সন্ধ্যা

দুপুরের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল আচমকা আওয়াজে। ঘুম এতো গভীর ছিল যে কিছুক্ষণ দেবারতি বুঝতে পারলেন না এখন সকাল না বিকেল। অতঃপর মন ফিরলো নিজ নিকেতনে। ঘড়ির দিকে চোখ। বিকেল চারটে বাবুই আর পিয়ালি অফিসে। নীচের তলায় সম্ববত নতুন ভাড়াটেরা জিনিসপত্র গোছাচ্ছে, সকাল বেলাতেই ওদের মালপত্র এসে গিয়েছিল।

আসলে বাবুই আর পিয়ালি দুজনেই অ্যামেরিকা চলে যাচ্ছে। তাই নীচের তলাটা ভাড়া দেওয়া। বাবুই ঘ্যামা একটা জব পেয়েছে মেরিল্যান্ডে। এমনি ভাষা বাবুই পাখির। পিয়ালি এখনো কিছু পায়নি। তবে একবার সেখানে গিয়ে পড়তে পারলে পেতে কতক্ষণ। সমস্ত প্ল্যান বাবুই নিজেই ঠিক করেছে মায়ের জন্য, বাড়ীর জন্য নিজেদের জন্যতার একদম ইচ্ছে নয় যে তারা দুজনে চলে যাবার পর মা এই দোতলা বাড়ীতে একলা থাকুক। দেবারতি বহু পুরানো অ্যাস্থমা রুগী। তাছাড়া প্রেসার ও হাই এর দিকেবাবুই নিজেই ওল্ড হোমের আইডিয়াটা দিলো। এসব গত তিন মাস আগেকার ঘটনা। বাবুইরা নিজেরা দুজনে অনেক ওল্ড হোম ঘুরেছে কথা বার্তা বলেছে অবশেষে গোটা তিন চার ফাইনাল করে মায়ের দরজায় হানা। মায়ের থাকবার জায়গা মায়ের পছন্দ মতই হবে।

একটা রোববার দেখে তিনজনে বেরলেন। প্রথমটার নাম আশালতা। বেশ বড়ো, তিনতলা, একটু প্রাচীন গন্ধ। এই গন্ধটাই দেবারতির পছন্দ হোলো নানিজেকে পুরনো মানুষ ভাবতে তিনি রাজি হলেন না। নাম্বার টুটা জাস্ট ফাটাফাটি । বাবুইর মতে । পিয়ালির ভাল লাগ্ল ঘরের লাগোয়া ব্যালকণিটা । একদম এইটুকু । আর ঘরটার রঙ হাল্কা নীল । দেবারতির মনে হোলো ঠিক এই রকম একটা নীল রঙ কোথায় যেন ...একটু শীত , শালটা টেনে নিলেন গায়ে । দেবারতি এই বৃদ্ধাবাসটি পছন্দ করলেন

নীচের তলায় আসবাবপত্র টানাটানির আওয়াজ হচ্ছে , কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে । বসবার ঘরে টিভিটা অন করে এক কাপ চা । রোজগেরে গিন্নী প্রোগ্রামটা এই সময় প্রতিদিন দেখেন দেবারতি । একটু পরেই রান্নার ছেলেটি আসবে । আজ বাবুইরা পার্টি তে যাবে , রাত হবে ফিরতে ওদের । সবে নতুন গিন্নীর সাথে আলাপ হোলো কি হোলো না বেল বাজলো । দরজা খুলে দেখলেন বাচ্চা একটি মেয়ে এই বছর পাঁচ বয়েস আর সম্ভবত সাথে ওর মা । তার বয়েস মনে হয় পিয়ালির মতই ।
নমস্কার , আমরাই নীচের তলায় এসেছি । আমার নাম মল্লিকা আর এ আমার কন্যা ধানসিঁড়ি । আপাতত আমরা তিনজন থাকবো , দিন কুড়ির মধ্যে আমার বাবাও এসে যাবেন । চার জনের সংসার আমাদের , আমরা দু বোন , বাবা কখনো দিদির বাড়ী কখনো আমাদের সাথে থাকেন দেবারতি বাচ্চাটার গাল টিপে দিলেন । মা মেয়ে দুজনেই খুব বকবকে । কি মিষ্টি মেয়ে তোমার আর নামটাও ভারি সুন্দর রেখেছ... তোমরা যখন বাড়ী দেখতে এসেছিলে তখন আমি হরিদ্বারে ছিলুম বোনের বাড়ীতে , তাই দ্যাখা হয়নি আগে ।
হুম। মল্লিকা বললো , তাই তো আলাপ করতে এলুম । আপনিও তো চলে যাচ্ছেন ... হু, যাচ্ছি বৃদ্ধাবাসে । দেবারতি হাস্লেন , আসলে আমার ছেলে পছন্দ করছে না আমি বাড়ীতে একলা থাকি , আমি অনেক বোঝালুম যে নীচেও তো লোকজন থাকছে ... কিন্তু ছেলে রাজী হোলো না , আসলে আমার শরীরটাও ভালো যায়না তেমন ... বৃদ্ধাবাসে অনেকের মাঝখানে থাকা , কথাবার্তা আড্ডা এগুলো জরুরি তাছাড়া নিয়মিত ডাক্তারের চেক আপের ব্যবস্থাও আছে সেখানে ......ছেলে মেয়ে বড়ো হয়ে গেলে তাদের কথা শুনেই চলতে হয় ।
মল্লিকা বললো , কিন্তু থাকলে ভালো লাগতো আমাদেরও , দেবাশিস তো বেশীর ভাগ সময় ট্যুরেই থাকে , আমি বাবা আর মেয়ে । সুধাংশুর ছবিতে চোখ আটকেছে মল্লিকার । দেবারতি কবে ছেড়ে এসেছেন পঁয়তাল্লিশ । কিন্তু মেহগিনি ফটোফ্রেমে সুধাংশু এখনও চল্লিশ , ঝকঝকে যুবক । চশমার ফ্রেম আঁচলে মুছলেন দেবারতি , তোমার মেশোমশাই , আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বহু বছর ।
মল্লিকাও বিষণ্ণ হোলো , আমার মাও অনেকদিন চলে গেছেন । আমার বাবাকে আপনি চিনলেও চিনতে পারেন । বাবা নতুন চাকরি পেয়ে যখন কলকাতায় আসেন তখন এ পাড়াতেই কোথাও ভাড়া থাকতেন । আমরা এখানে আসছি শুনেই বাবা খুব খুশি , বললেন সেকিরে , আমারি পুরনো পাড়া ...
আজ আসি মাসীমা ... পরে আবার আসবো । দেবারতি বললেন , এসো আবার বরকে , বাবাকেও নিয়ে এসো ... তোমার বাবার নাম কি ? নিখিল প্রামানিক ... মল্লিকার মেয়ে ছুটছে ... মল্লিকাও

একতলার ঘরের রঙ তখন ছিলো নীল । আজকেই সুধাংশুর রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন কি ভাগ্যিস সুধাংশুর অপেক্ষা না করে দেবারতি একলাই গিয়েছেন রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে । চেম্বারে বসে কাঁপছেন দেবারতি ... চোখের দিকে তাকিয়ে ডঃ সেন বলছেন , আপনারা অন্য কিছু ভাবুন না ... অ্যাডপ্ট করতে পারেন ... বা অন্য কিছু ... রাতে সুধাংশুর বুকে হাত রাখলেন দেবারতি । থ্যাঙ্ক গড , আমরা দুজনেই একদম নর্মাল ... আমার মন বলছে ... দেখো হয়তো সামনের মাসেই ...

পরের মাসে সুধাংশু তখন ট্যুরে । রাত নটা নাগাদ একতলায় । কলিং বেলে হাত রাখলেন দেবারতি । ঘরময় নীল , ব্যাচেলারস ডেন । অগোছালো শার্ট প্যান্ট আন্ডার গারমেন্ট ছড়ানো বিছানায় ... দেবারতি হাত রাখলেন নিখিলের ডেনিমে ... আঃ এতো নীল কেনো ...

বাবুইপাখি অবশ্য খুব ফর্সা , নীল শিরাগুলো উঁকি দ্যায় কখনো চামড়ার ফাঁক দিয়ে ।লোকে বলে ছেলে নাকি সুধাংশুর রঙ পেয়েছে আর নাক চোখ দেবারতির ।

বৃদ্ধাবাসে যাবার বেশী দিন বাকি নেই । টুকটাক জিনিসপত্র এরই মধ্যে গুছিয়ে ফেলেছিলেন দেবারতি , পছন্দের শাড়ি , গল্পের বই , অতুলপ্রসাদের সিডি ... নিজের বিয়ের একটা ছবি , বাবুই আর পিয়ালিরও
খুব দ্রুত দেবারতি জায়গার জিনিস সব জায়গামত গুছিয়ে রাখলেন ... বই, শাড়ি সিঁদুরদানের ফটোটাও বেরোলো অ্যামেরিকান ট্যুরিস্টার থেকে ... আঁচলে ছবিটা একবার মুছে শোবার ঘরের ছোট টিভির মাথায় রেখে দিলেন যেন আর কোত্থাও আর যাবার নেই তার ।

ছোট থেকেই সব্বাই জানে দেবারতি খুব গোছানো স্বভাবের মানুষ ।

৫টি মন্তব্য:

  1. Didi Darunnnnnn...... ki je porichhonno ar shundor ekta golpo porlam, bolar moto na. Apnar shob lekhai durdanto, ei golpota tar proman dilo. Onek onek obhinondon apnake :)

    উত্তরমুছুন
  2. গল্পটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো এত দিন লেখেন নি কেন? গল্প জীবনকে অনেক সুন্দর ভাবে প্রকাশ করে - কবিতা তাত্ক্ষণিক ঘনীভূত অনুভব দেয় | আপনি এখানে অনেক অনেক গল্প লিখবেন আমরা পড়ব দিদি |

    উত্তরমুছুন
  3. কিছু ছবি - জলরঙ - ভাষে আভাষে - সবচাইতে ভালো যা লাগল রঙের আধিক্য নেই, নির্লিপ্ত তুলির টান

    উত্তরমুছুন