কবিতার পরিবারের একমাত্র ব্লগজিন

এখনও পর্যন্ত  Website counter  জন ব্লগটি দেখেছেন।

শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ২য় সংখ্যা



এখন রোদ্দুর। আঁধারের উল্টোপিঠে চেয়ে আমরা আর আকাশ দেখি না। নিহত উল্কার পতনে খুঁজি চন্দ্রাতপের শান্তি। ফেনিল ঝোরোর জলে আজ কেবল শুভ্র শব্দের উল্লাস। এখন কেবল শিকার করি। নিহত মননের। মালা দিই। মনে মনে আবার বরণ করি। যেমন খুশি সাজাই। তারপর আপন করে টেনে নিই অন্তরের গভীরে। রোদ্দুরের পেটে ডুবে যায় সমস্ত আঁধার। একা অন্ধকার জেগে থাকে ছন্দময় ভোরের নেশায়। জানি না কবে ফিরে পাবে সেই ভোরের খোঁজ। ফুটে উঠবে পূব আকাশে সুরের মায়া। খুশিতে গেয়ে উঠবে মন। এ বুঝি নতুন জগত। চর্যাপদের ইতিহাস থেকে অনেক অনেক দুরে বাতাসে তখন ভেসে বেরাবে কল্পজগতের রক্তকরবী।

আসুন আমরা এখন ফিরে আসি কল্পলোক থেকে বাস্তবে। চিরপরিচিত কবিতার পরিবারে। জন্মলগ্নের শুরুতে যে আঁতুরঘরে আমরা দেখেছিলাম বীজপত্রের আলো। মননপুর্তির উদ্যান আমাদের সেই পারিবারিক ব্লগজিন। যেখানে সবাই হাসবে খেলবে ছুটে বেরাবে যেমন খুশি মন চায়। এটাই আমাদের পরিবারের অন্দরমহল। কল্পজগতের আপন ডেরা। এখানে কেউ বেশি কেউ কম। কেউ নবীন কেউ প্রবীন। কেউ শিল্পি কেউ যাদুকর। কেউ আপনভোলা কেউ বা নীলিমায় নীল। কেউ বেচে রূপের পসরা কেউ হাঁটে মরুদ্যানে। তবুও সবাই শেষ বেলায় বয়ে নিয়ে যায় অনাবিল স্বর্গীয় আনন্দ।


সত্যিই ভাষার প্রাচুর্য্যে হয়ত কখনোই বর্ণনা করা সম্ভব হবে না এই প্রথম দশকের নবীন সাহিত্য চর্চার পটভুমি - ব্লগজিন। বৈদিক যুগে আরম্ভ হয়েছিল সামগান। মনে রাখার সুবিধার জন্য এসেছিল ছন্দ। তারপর চর্যাপদ তাকে দিয়েছিল সাহিত্যের রূপ। ছিল পদাবলী কীর্তন। পয়ার ছন্দের আবির্ভাব। একসময় বিদেশী সাহিত্যের হাতধরে বাংলা সাহিত্যেও এসেছিল সনেট-চতুর্দশপঙতিমালা। এসেছিল অনুবাদ সাহিত্য। হাইকু-এপিটাফ-কাসিদ্দা-লিমেরিকের জগত। আস্তে আস্তে মানুষ হারিয়ে ফেলছে সেই প্রাচীন অন্তমিলের জগত-ছন্দ-সুরের জাল। কবিতার জগত মিশে যাচ্ছে গদ্যের জগতে। গদ্যকবিতা না কবিতাগদ্য সেই নিয়ে মন কষাকষিতে চলে গেছে অনেক রাত্রি। কবিতার পরিবারেও এসেছে বিবর্তন। নতুন জগতে নেই কোন অন্তমিলের ভাষা। কমে আসছে যতি চিহ্নের ব্যবহার। নতুন শব্দের খোঁজে মুক্তির পথ হেঁটে মিলন ঘটেছে একাধিক শব্দের। জন্ম নিয়েছে যুক্তশব্দ। অমৃতাক্ষর ব্রাত্য
আজ। মুক্তগদ্যের পৃথিবীতে নতুন আলোর রোশনাই। চলেছে আলোআঁধারির বেচাকেনা। অগনিত স্বেদবিন্দুর বদলে আজ নবযুগসাহিত্যের পদার্পন। আমরাও ফিরে তাকাব না আর পুরানো সেই জগতে। ফিরে যাব না অন্তমিলের জেলখানায়। সকলে মিলে বরং সাক্ষী হয়ে থাকি নতুন সাহিত্যযুগসূচনার। বাংলা সাহিত্যের পোস্টমডার্ন অবয়বের।

প্রকাশিত হল 'পারিবারিক ২য় সংখ্যা'। অনেক স্বপ্ন অনেক আশার ফসল। অনেক আদর যত্নে  বড় হয়ে উঠেছে আমাদের শিশু। সুবেশ রূপ ধারন করেছে তারা সকলে। নতুন সেই আলোর বন্যায় ভেসে গেছে সব বিষাদবিবাদ। মিলন ঘটেছে শুভ উচ্ছাসের। চিৎকার করে আমরা সকলে বলব - ঈশ্বর আমরা বেঁচে আছি, বাঁচতে চাই
আমরা। গড়তে চাই আমাদের জগত আমাদের মত করে। তারপর হাতে হাতে রেখে একসাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবো পারিবারিকের মিলনমেলায়। নতুন সূর্য মিশে যাবে সৃষ্টির ভীড়ে।



পারিবারিকের পক্ষে    
-- সুমিত রঞ্জন দাস

সরদার ফারুক

ছন্দ নিয়ে কিছু সহজ কথা


শুরুতেই বলে রাখি এটা কোনও মৌলিক লেখা না , এবং অগ্রসর ছন্দচর্চাকারীদের জন্যও লেখা হয়নি ।

ছন্দের প্রয়োজনীয়তা

যদিও গদ্যছন্দ বলে একটা ছন্দ আছে , এবং সমর সেনসহ অনেক বিখ্যাত কবিই গদ্যছন্দে লিখেছেন , তবু আমি মনে করি ছন্দের প্রয়োজন কখনো ফুরোয়নি আর ফুরোবেও না ।কবিতায় আমরা যে দোলা বা স্পন্দের কথা বলি তা এই ছন্দ থেকেই আসে ।অনেকে ছন্দকে বন্ধন মনে করে বন্ধনমুক্তিতে বিশ্বাসী । তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি-রবীন্দ্রনাথ সেতারের উদাহরন দিয়েছিলেন । সেতারের তারের বন্ধনেই সুরের মুক্তি ।বন্ধনে মুক্তি অদ্ভুত শোনালেও চূড়ান্ত মুক্তি মানে বিশৃঙ্খলা । ছন্দে লিখুন বা না-ই লিখুন , জেনে রাখাটা দরকার । এটা কোনও আকাদেমিক আলোচনা না , কেবল একটা সহজ গাইড লাইন ।

৩ ধরনের ছন্দ

আপনারা নিশ্চয় জানেন বাংলা কবিতার ছন্দকে মোটামুটি তিন ধরনের বলে ধরে নেয়া হয় , অক্ষরবৃত্ত ,মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত ।মাত্রাবিচারের রীতিভেদে ছন্দও পাল্টে যায় ।

মাত্রা কাকে বলে ?

সোজা কথাই মাত্রা মানে পরিমাপক অর্থাৎ ইউনিট অফ মেজার ।জল মাপি লিটারে , কাপড় মাপি মিটারে আর ছন্দ মাপি মাত্রায় ।কবিতার এক - একটি পংক্তির মধ্যে যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে , এবং তাকে উচ্চারন করার জন্য মোট যে সময় আমরা নিয়ে থাকি , সেই উচ্চারনকালের ক্ষুদ্রতম এক-একটা অংশই হল মাত্রা । প্রবোধচন্দ্র সেন তারই নাম দিয়েছেন কলা । কলা মানে এখানে অংশ । ষোল কলায় যেভাবে চাঁদ পূর্ণ হয় , তেমনি কলা বা মাত্রার সমষ্টি দিয়ে তৈরি হয় পূর্ণ এক-একটি পংক্তি(লাইন) উচ্চারনকাল ।

কঠিন লাগছে ? আরো সোজা ভাবেই মাত্রাবিচারের পদ্ধতি নিচে আলোচনা করবো ।

অক্ষরবৃত্ত

বাংলা কবিতার খুবই বনেদি ছন্দ ।রবীন্দ্রনাথের আগে , রবীন্দ্র কাব্যের সূচনাপর্বেও বাংলা কবিতা প্রধানত অক্ষরবৃত্তেই লেখা হয়েছে , এবং বিস্ময়করভাবে এখন পর্যন্ত অক্ষরবৃত্ত তার শীর্ষ আসন ধরে রেখেছে ।

জীবনানন্দের গ্রণ্হভূক্ত কবিতার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো ।এই মোট ৩৫২টি কবিতার ২৭৫টি অক্ষরবৃত্তে ,মাত্রাবৃত্তে ১৬টি , স্বরবৃত্তে ৩৭টি এবং গদ্যছন্দে ২৪টি ।ভেবে দেখুন !

আমার জানা মতে বিনয় মজুমদার তাঁর সমস্ত কবিতা অক্ষরবৃত্তে লিখেছেন (উনি অবশ্য পয়ার বলতেন ) । আমারতো মনে হয় , একজন কবি শুধু অক্ষরবৃত্তে লিখেই কবিজীবন পার করে দিতে পারেন ।

অক্ষরবৃত্তের মাত্রাগণনা

অক্ষরবৃত্তের লক্ষণ কী ?লক্ষণ মোটামুটি এই যে , এ ছন্দে যত অক্ষর বা বর্ণ , তত মাত্রা অর্থাৎ কিনা প্রতিটি অক্ষরই এখানে ১টি মাত্রার মর্যাদা পেয়ে থাকে , যেমন -

১/শ্যামল সুন্দর প্রভু কমললোচন (১৪ মাত্রা -গুণে দেখুন )
২/পোড়া প্রণয়ের বুঝি জরামৃত্যু নাই (১৪ মাত্রা )

বিনয় মজুমদারের সহজ ফর্মুলা-

“বাংলা অক্ষরের উপরে যে মাত্রা দেয়া আছে আমি তাকেই মাত্রা বলি ।যথা , ‘অ’ অক্ষরের উপরমাত্রা দেয়া আছে ,সুতরাং অ অক্ষরে একটি মাত্রা । ‘ত’ অক্ষরে মাত্রা দেয়া আছে সুতরাং ত অক্ষরে একটি মাত্রা । ‘স্ক’ ‘ল্ল’ ইত্যাদিতেও একটি মাত্রা ।অর্থাৎ অক্ষরবৃত্তে যুক্তাক্ষরেও একটিই মাত্রা ।‘ৎ’ তে মাত্রা নেই , তাই ‘উৎফুল্ল’ অক্ষরবৃত্তে ৩ মাত্রা , ‘হঠাৎ’ ২ মাত্রা ।তিনটি অক্ষরও যদি যুক্ত থাকে যেমন ‘উজ্জ্বলে’ –‘জ্জ্ব’ কে এক মাত্রা গণনা করে মোট ৩ মাত্রা হবে ।”

“ এটাই নির্ভুল ও প্রাথমিক নিয়ম । অবশ্য এর পরেও অল্প কিছু ছোটো নিয়ম আছে ।

স্বরবর্ণে ‘এ’ অক্ষরে , ‘ও’ অক্ষরে মাত্রা নেই । কিন্তু ‘এ’ অক্ষরে সর্বদাই এক মাত্রা ধরতে হবে , যেমন ‘এসো’ ২ মাত্রা ।‘এখন’ ৩ মাত্রা ।

‘ও’ অক্ষরে মাত্রা নেই । তবে অধিকাংশ শব্দেই ‘ও’ অক্ষরে একমাত্রা ধরতে হবে ।অল্প কয়েকটি শব্দে ‘ও’ অক্ষরে শূন্য মাত্রা । ‘ওঠ’ ২ মাত্রা , কিন্তু ‘হাওয়া’, ‘যাওয়া’ , ‘খাওয়া’ , ‘চাওয়া (অর্থাৎ- শব্দের শেষে ‘ওয়া’ থাকলে ) ‘ও’ শূন্য মাত্রা । এগুলোকে ২ মাত্রা বলেই গণ্য করতে হবে ।”

*( কেন করতে হবে সে বিশদ ব্যাখ্যাই না গিয়ে কেবল এই শব্দগুলো মনে রাখতে বলছি )

“এবার ব্যঞ্জনবর্ণ।ব্যঞ্জনবর্ণে প্রকৃতপ্রস্তাবে ‘ঙ’ এবং ‘ৎ’ - এই দুটি অক্ষরের উপরে মাত্রা আঁকা হয়না ।বাঙ্ময় , কঙ্কাল, অঙ্ক এবং অনুরূপ সব শব্দে ‘ঙ’ অক্ষরের সঙ্গে অন্য অক্ষর যুক্ত হয়ে যুক্তাক্ষর তৈরি হবার ফলে এই যুক্তাক্ষরে এক মাত্রা ।অর্থাৎ ‘কঙ্কাল ‘ ৩ মাত্রা , ‘অঙ্ক’ ২ মাত্রা ।

তবে শব্দের শেষে ‘ঙ’ থাকলে ‘ঙ’ অক্ষরে সর্বদাই একমাত্রা ধরতে হবে । যেমন -‘রঙ’ ২ মাত্রা ।

‘ৎ’ শব্দের মাঝে থাকলে শূন্যমাত্রা । যেমন ‘উৎপ্রেক্ষা ’ ৩ মাত্রা । আবার শব্দের শেষে থাকলে ‘ৎ’ ১ মাত্রা দাবি করে , যেমন ‘প্রদোৎ’ ৩ মাত্রা , ‘হঠাৎ’ ৩ মাত্রা ।”

‘মাত্রা গণনার নিয়মাবলী এখানে সমাপ্ত । বাংলা অভিধানের এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার- এর অধিক শব্দগুলির মাত্রাগণনা এই অল্প কটি নিয়ম দিয়েই আমি সারা জীবন করেছি ।”

আমরা অক্ষরবৃত্তে মাত্রা গণনার নিয়ম আলোচনা করেছি ।এবারে একটি পংক্তিতে (লাইনে ) কয় মাত্রা বসানো যায় সেকথা বলছি ।অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চাল আসলে ৪ মাত্রার চাল । প্রতিটি পর্বে (অংশে ) থাকে ৪টি মাত্রা , শেষে থাকে ২ মাত্রার ভাঙা পর্ব ।সোজা কথায় অক্ষরবৃত্তে মাত্রাসংখ্যার ফর্মুলা হচ্ছে ৪ এর গুণিতক +২ ।

যেমন :
৪ x ১ +২ = ৬
৪ x ২ + ২ = ১০
৪ x ৩ + ২ = ১৪

এই নিয়মে ১৮, ২২ , ২৬ , ৩০ এভাবে মাত্রাসংখ্যা হতে পারে ।অবশ্য অত বড়ো লাইন কেবল জীবনানন্দ দাশই লিখে গেছেন ।

*৬ মাত্রার পংক্তি ভেঙে দেখাই --

খেলাঘর/ভাঙে
ঝড়ের আ/ঘাতে ।

*১০ মাত্রা ভেঙে দেখাই --

মুখ নেই,/লোভ ফুটে/ আছে ;
শিকারীর /সহজ উ/দ্যম
নিরঙ্কুশ /সফলতা / আছে ।

( উদাহরনগুলো এই অকবির রচনা বলে ভাল নাও লাগতে পারে )

*১৪ মাত্রা ভেঙে দেখাচ্ছি --

সহসাই / ফুঁসে ওঠে /কুলীন গো/ক্ষুর
অন্ধ রোষে /বিষ ঢালে/ নরম মা/টিতে ।

• ১৮ মাত্রার উদাহরন---

বজ্রের উ/ল্লাসে খোলে/বৃক্ষদের/তৃষ্ণার দ/রোজা ।

*২২ মাত্রার উদাহরন বিনয় মজুমদারের কবিতা থেকে --

সুদূর স/মূদ্রজলে/ একটি গী/টার ভেসে/চলেছে এ/খন
যখন স/কলে ডুবে/ নিশ্চিহ্ন হ/য়েছে /সব হারিয়ে গি/য়েছে ।

আর উদাহরন বাড়াবো না ।আপনারা ২৬ মাত্রা এমনকি ৩০ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে নিজেরাই খুঁজে বের করুন ।

আরো কিছু জরুরী কৌশল

এভাবে ৪ মাত্রা করে লিখতে গেলে পাগল হয়ে যাবেন । তাই সহজ কায়দা হলো-দুটো মহাপর্বে লাইনটাকে ভাগ করে নেয়া ।প্রথম মহাপর্বে থাকবে ৮মাত্রা , বাকি মাত্রাগুলো পরের মহাপর্বে ।অর্থাৎ ভাঙতে হবে নিচের নিয়মে ।

(*৬ মাত্রা এভাবে ভাঙার কিছু নেই )

১০ মাত্রা=৮+২
১৪ মাত্রা= ৮+৬
১৮ মাত্রা+৮+১০
২২ মাত্রা=৮+১৪

এইভাবে বাকিগুলো আপনারা ভেঙে নিন ।
এই নিয়মে ভাঙলে লাইনের নতুন চেহারা হবে--

সম্রাজ্ঞীর মতো চোখে/তার খেলা করে
অযুত গোলাপ , আর/ পাতক কীটেরা
কুরে কুরে খায় সেই /চোখের ঐশ্বর্য
তীব্র হিমে ক্ষয়ে যায়/ফুলের প্রতিভা ।
(অধমের অক্ষম কবিতাকে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন। )

এরপরে সবচে’ জরুরী কথা হচ্ছে , প্রথম ৮ মাত্রার মহাপর্বকে না ভাঙার চেষ্টা করবেন । যেমন এভাবে ভাঙবেন না --
তোমাদের এখানে পা/হাড়ী ঝর্ণা আছে ?

*এভাবে ভাঙলে একবারে অশুদ্ধ হবেনা , তবে পাঠকের পড়তে কষ্ট হবে । তাই যতটা সম্ভব ৮ মাত্রার প্রথম মহাপর্বকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চেষ্টা করবেন ।

অক্ষরবৃত্তের আরো কিছু নিয়ম
শব্দের পরে শব্দ গাঁথারও একটা নিয়ম আছে ।ছন্দের জাদুকর নামে খ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একটা সোজা কথা বলে দিয়েছেন -- বিজোড়ে বিজোড় গাঁথো , জোড়ে গাঁথো জোড় । অর্থাৎ বিজোড় শব্দের সাথে বিজোড় শব্দ এবং জোড় শব্দের সাথে জোড় শব্দ ব্যবহার করবেন ।কেন করবেন ? কারন তাহলে পাঠকের কান আহত হয়না ।

কখনো নিচের নিয়মে সাজাবেন না--
৩+২+৩ , ৫+২+১ ,২+৩+৩ ,কেউ কেউ অবশ্য ৫+৩ ও নিষেধ করেন ।অবশ্য ৩+৫ ঠিক আছে ।
আপাতত অক্ষরবৃত্তের নিয়মের আলোচনা এখানেই শেষ করছি । এটুকু আস্তে আস্তে অনুশীলন করুন ।অল্প কিছু কথা বাকি কিস্তিতে দিয়ে দেবো ।অবশ্য এই আলোচনাটুকুও আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয় ।

জরুরী একটা ভুলে বসে আছি । এখন অক্ষরবৃত্ত বেশির ভাগই অমিল মুক্তকে লেখা হয় ।অমিল তো বুঝতেই পারছেন অন্ত্যমিল নেই (অবশ্য অন্ত্যমিলেও দারুণ কবিতা লেখা যায় ) , আর মুক্তক মানে বিভিন্ন লাইনের বিভিন্ন দৈর্ঘ্য হতে পারে একই কবিতায় ।যেমন এক লাইনে ১৪ আবার পরের লাইনে ১০ ,তারপর আবার ৬ কিংবা ১৮ , কবির প্রয়োজনে ।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ

ভূমিকা:
বন্ধুরা , আমরা অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আলোচনা মোটামুটি শেষ করেছি । এবারে আমরা মাত্রাবৃত্ত নিয়ে কথা বলবো ।প্রথমেই বলে নেই , এই পদ্ধতি অ্যাকাডেমিক পদ্ধতির থেকে ভিন্নতর । কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছন্দ শেখার যে সহজ ফর্মুলা দিয়েছেন - তা থেকেই মূলত আমি আমার মতো করে সংক্ষেপে মাত্রাবৃত্তের নিয়মগুলো তুলে দিচ্ছি । তবে এ ও বলে রাখি - স্বরবৃত্ত ছন্দের ক্ষেত্রে কিন্তু এইসব সহজ ফর্মুলায় চলবেনা , সেক্ষেত্রে সিলেবল বা দল ( মুক্তদল ও রুদ্ধদল)দিয়েই মাত্রার হিসাব করতে হবে । ওখানে আর অক্ষর দিয়ে হিসাবের সহজ কায়দা চলবেনা ।সিলেবল হচ্ছে উচ্চারণের এক-একটি ইউনিট বা একক ।অর্থাৎ স্বরবৃত্তে আর চোখের হিসাব চলবেনা , কানের বিচারে চলতে হবে বেশি করে ।

আমি সহজ ফর্মুলার লোক , তাই মাত্রাবৃত্ত পর্যন্ত গিয়েই থেমে যাব । স্বরবৃত্ত নিয়ে যেহেতু নতুন কায়দা খুঁজে পাইনি , সেহেতু ওটা নিয়ে আপাতত আলচনা করছি না। আমার উদ্দেশ্য নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ? বাংলা কবিতার প্রধান ৩ ছন্দের মধ্যে যদি ২টি ছন্দের সোজা পদ্ধতি যদি আমরা জেনে নিতে পারি , আর কী চাই ?

বাংলা কবিতার সিংহভাগ এখনো এই দুটো ছন্দেই লেখা হয় । ছড়ার ছন্দটি স্বরবৃত্তেরওটা আপাতত আলচনা করছি না - তবে স্বরবৃত্তে জীবনানন্দ দাশসহ অনেক কবিই সার্থক কবিতা লিখেছেন । যাহোক , আমি নিজে অবশ্য একটাও লিখিনি ।

মাত্রাবৃত্তে মাত্রা গণনা :
অক্ষরবৃত্তে আমরা মোটের ওপর(কিছু ব্যতিক্রম আগেই উল্লেখ করেছি)যত অক্ষর তত মাত্রা এই ফর্মুলায় চলেছি । যুক্তাক্ষরকেও এখানে আমরা ১ মাত্রা দিয়েছি ।তবে মাত্রাবৃত্তে যুক্তাক্ষরকে কিন্তু পূর্ণ মূল্য দিতে হবে , অর্থাৎ ২ মাত্রা দিতে হবে ।অনেকেই তাই মাত্রাবৃত্তকে ‘যুক্তাক্ষর ভাঙা ছন্দ ’ বলে অভিহিত করেন ।একটা উদাহরন দেই--‘কষ্ট ’ শব্দটি অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা , কিন্তু মাত্রাবৃত্তে ভেঙে গিয়ে হবে ‘ ক ষ্ ট ’ - ৩ মাত্রা ।বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয় ? আরেকটা বলি - ‘ছন্দ’ অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা , আর মাত্রাবৃত্তে ৩ মাত্রা (ছ ন্ দ ) ।

তবে এখানেও একটা ব্যতিক্রম মনে রাখতে হবে । তা হচ্ছে শব্দের প্রথমে কোন যুক্তাক্ষর থাকলে সেটা ভাঙা সম্ভব নয় , সে কারনে মাত্রাবৃত্তেও সে ১ মাত্রাই পাবে । বোঝেন নি ? ধরুন ‘ক্লাস’ শব্দটি । এটি কিন্তু অক্ষরবৃত্ত , মাত্রাবৃত্ত দুই ছন্দেই ২ মাত্রা পাবে । কারন শব্দের শুরুতেই যুক্তাক্ষর ‘ক্ল’ কে ভাঙা যাচ্ছেনা ।

তাহলে সোজা কথায় আমরা জানলাম - শব্দের মাঝখানে অথবা শেষের যুক্তাক্ষরকে আমরা মাত্রাবৃত্তে ২ মাত্রার মর্যাদা দেব , আবারও বলি শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে ১ মাত্রা-ই দেব ।

রবীন্দ্রনাথই এই ছন্দের স্রষ্টা । ‘মানসী’ পর্বের কবিতা থেকেই এই ছন্দের সূচনা । ‘মানসী’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন , “ আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি।” বোঝাই যায় , এখানে পূর্ণ মূল্য বলতে ২ মাত্রার মূল্য ।

যুক্তাক্ষরের বাড়তি বোঝা নিয়ে অক্ষরবৃত্ত যদি হাতির চালে চলে , মাত্রাবৃত্ত চলে তেজী ঘোড়ার মতো ।
অক্ষরবৃত্ত জোড়া দিতে চায় , মাত্রাবৃত্ত চায় ভাঙতে ।

মাত্রাবৃত্তের নানারকম চাল
আমরা অক্ষরবৃত্তকে দেখেছি ৪ এর চালে চলতে ।এর লাইন তৈরি করেছি ৪ এর গুণিতক + ২ দিয়ে ।এখানে মাত্রাসংখ্যা সব সময় আমরা ৪ যোগ করে বাড়িয়েছি , যেমন ,৬ ,১০ ,১৪, ১৮,২২ - মনে আছে নিশ্চয় ?কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন করতে পারেন ওখানে আবার +২ কেন বাপু ?এরও কারন আছে , ছন্দোগুরুরা এম্নি এম্নি এই বাড়তি ২মাত্রা সবখানে রাখেননি ।কবিতা পড়তে পড়তে একটু দম ফেলার অবকাশ চাই, একটানা ছুটতে গেলে নাভিশ্বাস উঠে যেত ।ঐ ২ মাত্রাতেই সেই দম ফেলার জায়গা ।

বাড়তি ২ মাত্রা না থাকলে এ রকম হতো :
বাজে লক্ষ ঢাকঢোল
চতুর্দিকে হট্টগোল ।
আর সহ্য হয় কত ,
প্রাণ হল ওষ্ঠাগত ।
ভক্তেরা বিষম খান ,
দলে দলে মূর্ছা যান ।

--দাঁড়ি-কমা থাকা সত্ত্বেও লাইনের শেষে দাঁড়ানো যাচ্ছেনা । ছন্দের তাড়না প্রবল হয়ে পাঠককে পাগলের মতো ছুটিয়ে মারছে ।

অক্ষরবৃত্তের চাল কেবল ৪ মাত্রার চাল , তবে মাত্রাবৃত্তের চাল কিন্তু এক ধরনের নয় । হ্যাঁ , মাত্রাবৃত্ত নানান চালে চলে ।
এখানে অক্ষরবৃত্তের মতো ৪ মাত্রার চালের পাশাপাশি ৫ মাত্রার চাল , ৬ মাত্রার চাল , আর ৭ মাত্রার চাল আছে ।
লাইনের এক-একটা অংশে বা পর্বে মাত্রাসংখ্যা দিয়েই আমরা বিচার করবো , কোনটা কত মাত্রার চাল ।কঠিন লাগছে ? আরে ভাই , উদাহরন দিতে শুরু করলে দেখবেন পানির মতো !

মাত্রাবৃত্তে ৪ মাত্রার চাল একটা বানিয়ে ফেলি ---

নির্জন রাত্রিতে কাকে তুমি ডাকো ?
কান্নার জল দিয়ে কার ছবি আঁকো !

ভেঙে দেখাই---
নির্জন/রাত্রিতে/কাকে তুমি/ডাকো ?
কান্নার/জল দিয়ে/ কার ছবি/আঁকো?

(ইসরে , কাঁচা পদ্য একেবারে ! যাক বাপু ছন্দ বোঝা গেলেই চলে । এখানে নির্জন =নি র্ জ ন , রাত্রিতে=রা ত্ রি তে ,কান্নার=কা ন্ না র )

*এখানে কী দেখছি ? ৩ টে করে ৪ মাত্রার পর্ব(অংশ) প্রত্যেক লাইনে , শেষে একটা ২ মাত্রার ভাঙা পর্ব ।ভাঙা বলছি এ জন্য যে , এটি ৪ মাত্রার তো আর নয় ।

যাহোক , মাত্রাবৃত্তে এই ভাঙা পর্ব আপনি রাখতেও পারেন , নাও পারেন । ভাঙা পর্বের মাত্রাসংখ্যা ১, ,২ বা ৩ - আপনার ইচ্ছেমতো রাখতে পারেন ।

আরেকটা উদাহরন তৈরি করা যাক --
অস্ফুটে বলেছে সে কী ,
আমি তার কিছু শুনিনি ।

*ভেঙে দেখি চেহারাটা--
অস্ফুটে/বলেছে সে/ কী ,
আমি তার /কিছু শুনি/নি

** অস্ফুটে ( অ স্ ফু টে - ৪ মাত্রা )।এখানে দেখা যাচ্ছে প্রত্যেক লাইনে ২টা করে ৪ মাত্রার পর্ব ,আর একটি করে ১ মাত্রার ভাঙা পর্ব ।

তাহলে বোঝা গেল প্রতি লাইনে পর্বের সংখ্যা আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে ।ভাঙা পর্বেও বৈচিত্র্য আনতে পারেন । ইচ্ছে করলে প্রতিটি লাইন শেষে একই মাত্রার আবার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার ভাঙা পর্ব রাখতে পারেন ( ১,২,৩ ) ,আবার না ও রাখতে পারেন ।

আর একটা কথা - অন্ত্যমিল রাখা না রাখাও কিন্তু আপনার ব্যাপার ।

মাত্রাবৃত্তে ৫ মাত্রার ছন্দ

এবারে ৫ মাত্রার কিছু দৃষ্টান্ত দেয়া যাক -

তোমার চোখে কিসের ছায়া গভীর কালো ?
ছিন্ন পাতা ঝরে পড়ছে হাওয়ার হাতে ;
কোথাও যেন মেঘ জমেছে বিষণ্নতার
কেউ জানেনা কারনটা কী মন খারাপের ।

পর্ব হিসাবে ভাঙলে এ রকম দাঁড়াবে :

তোমার চোখে/ কিসের ছায়া/ গভীর কালো ?
ছিন্ন পাতা/ ঝরে পড়ছে/ হাওয়ার হা/তে ;
কোথাও যেন/ মেঘ জমেছে/ বিষণ্নতা/র
কেউ জানেনা/ কারনটা কী/ মন খারাপে/র ।

* প্রতি লাইনে ৫ মাত্রার ৩টি করে পর্ব । প্রথম লাইনে ভাঙা পর্ব নেই ।অন্যগুলোতে ১ মাত্রার ভাঙা পর্ব ।(ছিন্ন = ছি ন্ ন /৩ মাত্রা , বিষণ্নতা= বি ষ ণ্ ন তা/৫ মাত্রা )।

এই দুর্বল কবিতায় মন না ভরলে ভাল একটা কবিতা দেই :
আসতে-যেতে এখনো তুলি চোখ
রেলিঙে আর দেখিনা নীল শাড়ি ।
কোথায় যেন জমেছে কিছু শোক ,
ভেঙেছ খেলা সহসা দিয়ে আড়ি ।
এখন সব স্তব্ধ নিরালোক ;
অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে বাড়ি ।
---নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ।

ভেঙে দেখালে---
আসতে-যেতে/ এখনো তুলি/ চোখ
রেলিঙে আর/ দেখিনা নীল/ শাড়ি ।
কোথায় যেন/ জমেছে কিছু/ শোক ,
ভেঙেছ খেলা/ সহসা দিয়ে/ আড়ি ।
এখন সব/ স্তব্ধ নিরা/লোক ;
অন্ধকারে /ঘুমিয়ে আছে/ বাড়ি ।

*দুটো করে ৫ মাত্রার পর্ব সাথে ২ মাত্রার ভাঙা পর্ব ।

আগেই মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে আমরা ঘোড়ার চালের সাথে তুলনা করেছি ।আপনারা সবাই নিশ্চয় অশ্বখুরধ্বনি শুনেছেন ? ৪ মাত্রার চাল এর ধ্বনি যদি হয় খট্ খট্,খট্ ,খট্ ; ৫ মাত্রার ধ্বনি তবে খটাশ খট্ , খটাশ খট্ ।অন্য কথায় বলা যায় - বেজোড় জোড় , বেজোড় জোড় । মাঝে মাঝে অবশ্য জোড়-বেজোড় হয়ে গেলে তেমন কিছু দোষের নয় ।

মাত্রাবৃত্তে ৬ মাত্রার ছন্দ
উদাহরন দেয়া যাক :
খেলার মধ্যে ভুল হলে আর নতুন খেলার
সুযোগ তো নেই ।তলিয়ে যাচ্ছো ভুল আবর্তে ,
আসবেনা কেউ অন্ধকারের অতল গুহায় ।

*খুব একটা সুবিধার হলনা । তবু এখানে দুটো বিষয় দেখাচ্ছি -১/ ভাঙা পর্ব রাখিনি ,২/অন্ত্যমিল রাখিনি ।ভেঙে দেখাবো না কি আপনারাই ভেঙে দেখবেন ?

আরেকটা উদাহরন দেই । এবারে নীরেন্দ্রনাথ থেকে :
যন্ত্রণা থেকে আনন্দ জেগে ওঠে
শোক সান্ত্বনা হয় ;
কাঁটার ঊর্ধ্বে গোলাপের মতো ফোটে
সমস্ত পরাজয় ।

ভাঙলে ---
যন্ত্রণা থেকে/ আনন্দ জেগে/ ওঠে
শোক সান্ত্বনা/ হয় ;
কাঁটার ঊর্ধ্বে/ গোলাপের মতো/ ফোটে
সমস্ত পরা/জয় ।

* এখানে দেখলাম সব লাইনে পর্বসংখ্যা সমান নয় । প্রথম আর ৩য় লাইনে ২টি করে পর্ব , কিন্তু ২য় আর ৪র্থ লাইনে ১টি করে পর্ব । আবার অন্ত্যমিলেও বৈচিত্র্য -১ম-৩য় ,২য়- ৪র্থ । ভাঙা পর্ব অবশ্য সবখানেই ২ মাত্রার ।পর্বসংখ্যায় এই বৈবিচিত্র্যের নিরীক্ষাটি অবশ্য রবীন্দ্রনাথের আগেই শুরু করেন কবি বিষ্ণু দে ।

৭ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত
এটা শেষ করতে পারলে এই যাত্রা বেঁচে যাই ।

৪ ,৫ ,৬ মাত্রার তুলনায় ৭ মাত্রায় লেখা কবিতার সংখ্যা খুব কম ।রবীন্দ্রনাথের পরেও অনেকে ৭ মাত্রায় লিখেছেন , তবে আজকাল তেমন একটা দেখিনা ।

একটা উদাহরন দিয়েই কেটে পড়বো :
কে যেন বারেবারে তার
পুরনো নাম ধরে ডাকে ;
বেড়ায় পায়েপায়ে , আর
কাঁধের পরে হাত রাখে ।

ভাঙলে এ রকম --
কে যেন বারেবারে/ তার
পুরনো নাম ধরে /ডাকে ;
বেড়ায় পায়েপায়ে ,/ আর
কাঁধের পরে হাত/ রাখে ।

আপাতত এখানেই শেষ করছি । এরপরে সময় পেলে ছন্দের নানারকম নিরীক্ষা নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে আছে । যারা বিষয়গুলো আরও ভালভাবে জানেন , তাঁদের অংশগ্রহণে আরও শিখতে পারবো আশা করি ।

সহায়ক গ্রন্থ -
১। কবিতার ক্লাস - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২। ছন্দের বারান্দা- শঙ্খ ঘোষ
৩। ঈশ্বরীর স্বরচিত ও অন্যান্য নিবন্ধ - বিনয় মজুমদার

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য


সময়ের স্রোত  
(প্রথম কিস্তি)

অপুর আজকাল চোখ বন্ধ হলেই মনে হয়, অন্ধকার এক লেভেল ক্রসিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।সামনে দিয়ে ঝমঝম করে ছুটে যাচ্ছে মেল ট্রেন। ইঞ্জিনটা কখনও ডাবলু পি ষ্টীম ক্যানাডিয়ান, কখনও বা ডিজেল বা হালের ঝকঝকে ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ।
কামরা গুলো শনশন করে বেরিয়ে যায়, কখনও আলো আর আঁধার; পিচকিরি দিয়ে ছিটিয়ে।
অনেকবার চেষ্টা করেছে,  কটা কামরা আছে দেখতে, কিন্তু গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তার সারা জীবনভর হয় নি। তাই আর গোনাও হয় না।অন্ধকার জাঁকিয়ে বসে, ট্রেন চলে যাবার পর। তখন হু হু করে মন। ধূ ধূ করা কাকে বলে, হাড়ে হাড়ে বোঝে অপু।
আজকাল ১ মিলিগ্রাম আ্যালপ্রাজোলাম খায় অপু। তা প্রায় ৬ বছর হয়ে গেল। ঘুমের ওষুধের মৃদু ঝাঁকুনিতে, শরীর টা মনে হয় ট্রেনের কামরাতেই আছে।
ডাবলু পি ষ্টীম ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিনে টানা মেল ট্রেনটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনেই একটা কামরা! প্রতিটা জানলায় জ্বলছে আলো।
বক্তৃতা দিচ্ছে অপু-
কমরেডস,
ইউটিলিটি ভ্যালু আর একচেঞ্জ ভ্যালু প্রাচীন কালেই জানা ছিল। তাই কৃষক যখন তার নিজের প্রয়োজনে একটা কাস্তে কিনতে যেত, বিনিময়ে কর্মকার চাইত চাল। কৃষক ভাবত, কতটা চাল দেবে দুটো কাস্তের বিনিময়ে! অপর দিকে কর্মকার ভাবত, দুটো কাস্তের বিনিময়ে কতটা চাল চাইবে! টানাপোড়েনের অন্ত ছিল না। মার্ক্স বললেন- এক সের চাল তৈরী করতে যে পরিশ্রম করতে হয়, একটা কাস্তে তৈরী করতে সেই একই পরিশ্রম হয়, তবেই এক সের চাল; সমান সমান একটা কাস্তে। এটাই লেবার ভ্যালু।
ফার্ষ্ট ইয়ারের কিছু বাছা ছাত্র, ছাত্রীদের সামনে বলছিল অপু। বিনয় ঠকঠক শব্দ করে ঢুকল ঘরে।
অপুউউ- তুই ফার্ষ্ট ক্লাস পেয়েছিস। এম. এস. সি ( ফিজিক্স) এবার তোর নামের পাশে বসবে।
সবাই হই হই করে উঠল। খাওয়ান অপুদা। আজ থিয়োরিটিক্যাল সেলের ক্লাসটা বন্ধই থাক!
ঝকঝকে ইলেকট্রিক লোকোমোটিভে টানা মেল ট্রেনটা দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে যাওয়া শীততাপনিয়ন্ত্রিত কামরার ঝাপসা আলো বেরিয়ে আসছে।
সদ্য শিকাগো থেকে আসা ছোটো ভাইয়ের বউ, তানিয়া সামনে একটা হাফ প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে। উর্দ্ধাঙ্গে একটা ঢিলেঢালা জামা!
-এ কি তানিয়া! কবে এলি?
- এই তো দুদিন হলো!  বাপের বাড়ীতেই উঠেছি। ছেলে মেয়ের সামার ভ্যাকেশন। চলে এলাম।
- তা, এই হাফ প্যান্ট পরে!
- ও নোওও! এটা ক্যাপরি। বেশ কমর্ফোটেবল লাগে তোমাদের এই কলকাতার প্যাচপেচে গরমে। এখন তো কোলকাতাতেও এগুলো পরে বেরুয় সবাই! হাউ সিলি! তুমি সেই ব্লাডি কমি আ্যাটিটুডেই থেকে গেলে!!!! এই নাও- বিগ এ্যান্ড টল ষ্টোর্স থেকে তোমার একটা টি শার্ট এনেছি। যা লম্বা আর মোটা তুমি!!!!!!!!! আর একটা দাড়ি কাটার ফোম!
- মামা! টুমি তো জেটুকে সার্টটা ডিলে না। হঠাৎ বলে উঠল ছ বছরের ভাইপো!
চোখটা একটু গরম হলো কি তানিয়ার?
সেই তানিয়া! ভাইয়ের অনুরোধে তাকে দেখতে গেছিল। ভাই শিবপুরের প্রথম ব্যাচের কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ার! সব ফ্যাকালটি মিলিয়ে গোল্ড মেডাল পেয়ে ফার্ষ্ট ।
তানিয়া বলেছিল- আর দেরী করবেন না! বলে দিন, এ বিয়ে হবে কি হবে না! তখনই বলে দিয়েছিল অপু- হচ্ছে তো! আমি তো সেই কথাটাই বলতে এসেছি।
বাচ্চা মেয়ের মত খুশী হয়েছিল তানিয়া
ডিজেল লোকোমোটিভটা দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছনে সার সার কামরা। কোনোটাতে আলো জ্বলছে, কোনোটা অন্ধকার!
-             অপু, তুমি ডিসাইড কর! পার্টির কোন ফ্রন্টে তুমি কাজ করবে। বাচ্চুদা বলেছেন- তোমার ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টেই কাজ করা উচিত!
জীবনদার কথাটা মেনে নিল অপু! তার ভালোই লাগে ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টে কাজ করতে।
ইতিমধ্যে, একটা কলেজে আ্যড-হক আ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছে। একটু খচখচানি আছে! নিয়োগপত্রে লেখা- সাবজেক্ট টু পোলিস ভেরিফিকেশন! তা থাক! কমিউনিষ্ট পার্টি করা তো অপরাধ নয়!
ভালই হয়েছে! হাতে টাইম থাকবে, কলেজে ক্লাস নিয়ে। তার খুব ইচ্ছে বিড়ি শ্রমিক নিয়ে কাজ করার!
দিনে হাজার বিড়ি তৈরী করলে, ২ টাকা মজুরী। মেয়েরা পায় ১ টাকা! মহাজনের কাছে তৈরী বিড়ি দিলে, তার মধ্যে ৩০০ বিড়ি বাতিল। সেগুলো ফেরত-ও দেয় না। ওই ৭০০ বিড়ির মজুরী। পরে আবার সেই বাতিল বিড়িগুলো ব্যাবহার করে মহাজনেরা।
মিনিমাম ওয়েজ আ্যাক্ট অনুযায়ী ১০০০ বিড়ি তৈরী করলে ৫ টাকা মজুরী। কিন্তু, কোনো মহাজন দেয় না। মিনিমাম ওয়েজ ইনসপেক্টর আছে। কিন্তু, মহাজনের সামনেই জিজ্ঞেস করে, তারা ঠিকঠাক মজুরী পাচ্ছে কিনা! কোনো শ্রমিকই আর বলতে পারে না আসল কথাটাই। শুধু ঘাড় নাড়িয়ে, হ্যাঁ বলে চলে আসে সবাই!

মাসের ৩ তারিখে প্রিন্সিপ্যাল ডেকে পাঠালেন, তাঁর নিজের ঘরে।
-আসতে পারি? অপু বলল
- ও! মিষ্টার চ্যাটার্জ্জি!! প্লিজ কাম ইন। প্লিজ টেক ইয়োর চেয়ার!
-চেয়ারটা টেনে বসল অপু।
- আপনার তো একমাস হয়ে গেল!
- হ্যাঁ স্যার!
-ইটস টাইম, ইউ শুড গেট ইয়োর স্যালারি!
- হ্যাঁ স্যার!
- শুনুন! আপনাকে যে জন্য ডাকা!
- বলুন স্যার!
- ইয়ে মানে! আপনার মাইনে তো ৪০০ টাকা! ভাউচারে সাইন করবেন ৪০০ টাকারই, কিন্তু হাতে পাবেন ৩০০ টাকা! আ্যকাউট্যান্টের কাছে যান। নিয়ে নিন!
-কিন্তু, স্যার! ওই  বাকী ১০০ টাকাটা পাব না কেন?
-নো কোয়েশ্চেন! এটাই দস্তুর! আ্যডহকের সিস্টেমটাই এই!
- ঠিক আছে বুঝলাম, কিন্তু এই টাকাটা কোন খাতে যাবে, এটা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন!!!
-আর ইউ আস্কিং মাই ক্রেডিবেলিটি?
- নট আ্যট অল স্যার! জাস্ট, আই ওয়ান্ট টু ক্লারিফাই মাইসেলফ!
- শুনুন, আমার কাছে খবর আছে; আপনি কমিউনিস্ট পার্টি করেন। দু একটা খুনও করেছেন
- প্রথমটা সত্যি, দ্বিতীয়টা মিথ্যে! কমিউনিস্ট পার্টি করলেই কি খুন করে নাকি?
- তর্ক করছেন কেন? যেটা অভিযোগ, খবর নিয়ে জেনেছি, সেটা সত্যি। এবার আপনি কি চাকরিটা করতে চান কি চান না! যদি চান, তা হলে গিয়ে টাকাটা নিয়ে নিন। আদারওয়াইজ, ইউ উইল বি অন সিদিং কলড্রন! মাইণ্ড ইট!
মাথায় হাজার বিছের কামড়! বাবা রিটায়ার করবেন পরের মাসে। দুই ভাই আর বোন! এক আকাশ আশা, মাথায় নিয়ে বাবা বসে। অপুর একটা হিল্লে হয়ে গেছে। আর চিন্তা নেই!
অপু গর্জ্জে উঠল- ইউ মাষ্ট ক্লারিফাই মিঃ মজুমদার! সিদিং কলড্রন!!!!!! মাই ফুট! ইউ আর আ্যাকাউন্টেবল টু মি! ইটস মাই রাইট টু নো! আফটার অল, দিস ইস মাই হার্ড আনর্ড মানি! আই কানট আ্যফোর্ড টু সাইফন ইট, আ্যজ পার ইয়োর হুইমস।
-             ইংরেজী মারানো হচ্ছে?
-             মুখ সামলে কথা বলবেন! আর ইংরেজীটা আপনিই শুরু করেছিলেন।
-             কি করবেন আপনি? মারবেন!!!!!!
-             আমি ভদ্রলোক!
-             এই তো নমুনা দেখছি! স্যার না বলে, সারনেম ধরে বলছেন! এরপর তো ফার্ষ্ট নাম ধরে ডাকবেন!
-             ওটা আপনাদের কালচার! আমার নয়। যাক, আসল কথায় আসুন! পুরো টাকাটা দেবেন কি দেবেন না?
-             অয়েল, নিয়ে যান, বাট ইউ আর টারমিনেটেড!
-             মামা বাড়ী নাকি? সরকারী কলেজে আপনি কে, টারমিনেট করার?
-             সেটা দু দিন পরেই বুঝবেন! নাউ পুশ অফ!!!!!!

পর্ব-২

লোকটাকে বিয়ের ৩৮ বছর পরেও চিনল না কনক! আজকাল একটু ম্যাঁদা মেরে গেছে, কিন্তু তেজ আর গোঁ একই! প্রতিবাআআআআদ! এই প্রতিবাদ করেই গেল লোকটা! কোনোখানেই কমপ্রোমাইজ করবে না! অদ্ভুত মানসিকতা! বিয়ের আগে বাবা বলেছিলেন- খুব আদর্শবাদী ছেলে! তাই তোকে এখানেই বিয়ে দিচ্ছি! পার্টি করে। ভেবে নিয়ে বলিস! খুব রোমাঞ্চ হয়েছিল! মফঃস্বলে বাড়ী। ভোটের সময় শুনত- ভোট দেবেন কিসে? কাস্তে ধানের শীষে!
আরও একটা শ্লোগানও শুনত- কেউ খাবে আর কেউ খাবে না- তা হবে না, তা হবে না!!!!!!!!!!! খুব নাড়া দিত শ্লোগানটা! সত্যিই তো! এটা খুব অন্যায়! তাই, বি পিএফ এস. ফে নাম লিখিয়েছিল! টুকটাক সংগঠনের প্রোগ্রামেও যেত! পাশের বাড়ীর টুনী পিসি এসে নরম করে মাকে বলেছিল- মেয়ে যে আস্তে আস্তে মাকু হয়ে যাচ্ছে, মায়াদি! দিনকাল ভালো না! যা-তা হয়ে যেতে পারে, যে কোনো সময়! মা খুব বকেছিলেন! ফলে ইচ্ছে থাকলেও আর সেরকমভাবে অংশগ্রহণ করতে পারত না কনক! তাই আত্মীয় মারফত বিয়ের সম্বন্ধ আসতে, বাবা গিয়ে ছেলের বাবার সঙ্গে কথা বলে এসেছিলেন। ছেলের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। বাবা তো গলে জল!
অপুর বাবা বলেছিলেন- ভালো করে ভেবে দেখুন, বাঁড়ুজ্জে বাবু! ছেলে কিন্তু প্রায় বাউণ্ডুলে। দিনরাত পার্টি করে বেড়ায়, সেলসের চাকরীর ফাঁকে ফাঁকে। ওদের একটা ইউনিয়নও আছে। সেখানে অল ইণ্ডিয়া কনভেনার! কোনো গারান্টি নেই চাকরীর!
বাবা বলে এসেছিলেন- আমার কোনো আপত্তি নেই। আশা করি মেয়েও আপত্তি করবে না। মেয়ের মা, একটু বেগড়বাঁই করতে পারে- তা সেটা সামলে নেব। শুধু একটা কথা বলুন- এরকম ছেলে, বিয়ে করতে রাজী হলো কেন?
অপুর বাবা হাসতে হাসতে বলেছিলেন-এক বড়লোকের মেয়ে, ওর পিছু ছাড়ছে না! আমার বাড়ীও এসেছিল, মেয়ের বাবা!
ছেলে বলেছিল- আপনার মেয়ের সম্বন্ধে আমার বলার কিছু নেই! কিন্তু, আপনার গুণ্ডা লাগিয়ে ইউনিয়নের নেতাদের মারার কথা আমি জানি। আরও অনেক কথা জানি আমি! থাক, সে সব কথা। আপনাকে শ্বশুর ভাবতেই আমার ঘেন্না করবে! সরি, এটা আমাদের পারসোনাল লাইফে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তা ছাড়া- আপনার মেয়ের স্বপ্ন ভঙ্গ হলেই ছেড়ে পালাবে আমায়। দুধে- ভাতে বড় হওয়া মেয়ে আমার সঙ্গে টিঁকতে পারবে না! সিনেমায় এসব হয়। বাস্তবে অসম্ভব!
তারপরেই ছেলে আমায় বলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে! খোলাখুলি বলেছিল- আমার বিয়ের খুব দরকার! একটু সেফ থাকতে চাই। তোমার প্রতি আমার আস্থা আছে আমার। একটু দেখেশুনে মেয়ে সিলেক্ট করো।
মেয়ে আমি দেখব না। শুধু দেখ, মানসিকতার মিল যেন কাছাকাছি হলেও থাকে! তা বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগেই তো আপনি হাজির! বিমলও আপনাদের সম্বন্ধে খুলে বলেছে। মেয়েরও তো ব্যাকগ্রাউণ্ড আছে, বি.পি এস. এফের। ফোটো দেখেছি। পছন্দ!!! এই সব মেয়ে দেখার মধ্যে আমি নেই। খুব অপমানজনক, মেয়েদের পক্ষে। আমি নিজে স্বাধীনতা সংগ্রামী। ছেলের সঙ্গে রাজনৈতিক পার্থক্য আছে, কিন্তু এ ব্যাপারে আমি ছেলের সঙ্গে একমত!
ফিরে এসে, বাবা কনক কে সব খুলে বলেন। কনক তো ছেলের ফোটো দেখেই কাত! তার ওপর পার্টি করা ছেলে! মাকে নিয়ে ভয় ছিল, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল- মাও রাজী।
রেজিষ্ট্রী বিয়েই হলো শেষ পর্য্যন্ত। ছেলের খরচ করার সামর্থ্য নেই। দুই বাবারই একটু ইচ্ছে ছিল- লোকজন খাওয়ানো! অপু এমন রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল, যে আর কিছু বলতে কেউ সাহস করে নি।
রেজিষ্টার ফরম্যালিটিস সারার পর, সকলের সামনে কনকের দু হাত ধরে বলেছিল- কমিউনিষ্টরা আপন মত লুকিয়ে রাখতে ঘৃণা বোধ করে। এসো- এই কথাটা একসঙ্গে দুজনে বলি। ঘোরলাগা অবস্থায় কনক বিড়বিড় করে বলেছিল কথাগুলো, অদ্ভুত এক ভালো লাগা নিয়ে!

ফুলশয্যার রাতে, একটু জড়োসড় ছিল কনক! অপু একটা সিগারেট ধরিয়ে আস্তে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল- কনক, আমি কৃতজ্ঞ তোমার কাছে!
পাঁচটা শব্দে কনক ভালোবাসার ডাকটা পরিস্কার শুনতে পেল।দুহাত দিয়ে কপালটা ধরে চুমু খেল অপু! সারা গায়ে মাদকতা! সপেঁ দিল নিজেকে অপুর কাছে।সুডোল স্তনে সাপের মত অপুর হাত দুটো খেলা করতে লাগল। উন্মুক্ত হতে লজ্জা করছিল কনকের! অপুর সিগারেটের গন্ধটা বেশ পরিবেশ তৈরী করেছে।
ডুবে যাচ্ছে কনক! আনন্দের ভেলায় ভাসছে! বিবাহিত বন্ধুদের কাছ থেকে ঠারেঠোরে অনেক কিছু শুনেছে! গীতার বিয়ের পর সুমিতা, জিজ্ঞেস করেছিল- গীতা, সব হয়ে গেছে তোদের?
লাজুক হেসে গীতা বলেছিল- যাঃ!!!!
কনক এখন বুঝতে পারছে- সব হয়ে যাওয়াটা কি!!!!!!!!!!

তোমাকে তো নামতে হবে আমার সাথে! অপু বলল একদিন!

(চলবে)



মৌ দাশগুপ্তা

নীড় ছোট, ক্ষতি নেই

কবিবন্ধু নীল আর ওর বউ আঁখির একান্ত অনুরোধে অনেকদিন পরে শ্রাবনমাসের রবিবারের সকালটাকে চোখ মেলে দেখতে দেখতে চলেছি কলকাতা শহর ছাড়িয়ে শহরতলীর পথে। প্রবাসী চোখে যাচাই করছি কতটা পালটে গেছে আমার চিরচেনা শহরের পটভূমি!

নীল আর আঁখি দুজনেই আমার ছোটবেলার বন্ধু, একপাড়াতেই বড় হওয়া, স্কুল
থেকে কলেজে যাওয়া, বৈবাহিক সূ্ত্রে বাংলার বাইরে থাকলেও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের বদাণ্যতায় যোগাযোগে ভাঁটা পড়েনি। নীলের খুব ছোটবেলাতেই বাবা মা মারা যাবার কারণে ও ওর ঠাকুরদার কাছেই বড় হয়েছে। রুদ্রদাদু আমাদেরও খুব আপনজন.আজ সেই রুদ্রদাদুর পারলৌকিক কাজ উপলক্ষ্যেই যাচ্ছি। যতটা না রুদ্রদাদুর টানে,তার থেকে অনেক বেশী নীল,আঁখির মত ছোটবেলার বন্ধুদের টানে,পিছে ফেলে আসা বাল্যকালের সেই গাছপালা,পুকুরঘাট,স্কুলবাড়ী,খেলার মাঠ,ঝোপ জঙ্গল,মেঠোপথ,রাস্তাঘাটের টানে। অবশ্য মিথ্যে বলব না, ঠিক এই সময়েই হঠাৎ করে কলকাতায় সপ্তাহখানেকের একটা অফিসিয়াল ট্যুর পেয়ে যাওয়ায় আসার তাগিদটাও জোরালো হয়েছে। তার জন্য অবশ্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি,তবে সে প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। নীল ওদের বসতবাড়ীটা এক  সংস্থাকে
দান করে দিয়েছে, রুদ্রদাদুর কাজের দিনই ওখানে ওই  সংস্থা তাদের নতুন একটি বৃদ্ধাশ্রম শাখার উদ্বোধন করছে, “নীড়”। সে অনুষ্ঠান দেখার আগ্রহটাও ষোলোআনা আছে।।

যাবার পরে বুঝলাম, না আসলে সত্যিই অনেক কিছু মিস করতাম, অনেককে মিস
করতাম। আমার এখন আসা হয় কালেভদ্রে, কারো সাথেই সেভাবে দেখা সাক্ষাৎ হয়ে ওঠেনা, এবার একজায়গায় একসাথে অনেককে পেয়ে গেলাম। পুরানো বন্ধু, পুরানো পাড়ার মামা-মামী, কাকা কাকী, দাদা-বৌদি, দিদি-জাম্বুদের,অনেক নতুন মুখও দেখলাম। বেশ লাগছিল।

এক প্রাক্তন শিক্ষিকার সাথে দেখা হল, অবসরের পরে সমাজসেবা নিয়ে ব্যস্ত
আছেন শুনলাম। প্রনাম করে কুশল বিনিময়ের পর জানতে চাইলাম - অবসর জীবন কেমন কাটছে ।
উত্তরে তিনি জানালেন-
- ভালই, তবে খুব ব্যস্ত।
- কি নিয়ে?
- এই নিন্দা জ্ঞাপন, শোকজ্ঞাপন ও অভিনন্দন জানানো নিয়ে
- মানে?
- কেউ খারাপ কিছু করলে তার জন্য নিন্দা জ্ঞাপন, কেউ মারা গেলে তার জন্য শোক জ্ঞাপন আর কেউ ভাল কিছু করলে তাকে অভিনন্দন জানানো।
- এতে আসলে কি হয়, বুঝতে পারছি না, দয়া করে একটু যদি বিষয়টা পরিস্কার করে বলতেন!!
- আমি যে এখনও আছি এটা জনগণকে জানানো মানে জনগনের সাথে ক্লোজ কন্ট্যাক্টে থাকা আর কি।
আর কথা বাড়ালাম না, বুঝলাম পরিবর্তন সব জায়গাতেই ছায়া ফেলছে। হঠাৎই মনে পড়ল আমাদের স্কুলের বড়দিদিমনির কথা, বিখ্যাত বিপ্লবী সতীশ সেনের ভাগ্নী, সেই সময়কার ট্রিপল এম.এ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার গায়েত্রী সেনগুপ্তার কথা।বেঁচে থাকলে এই পরিবর্তন কি গায়েত্রী দিদিমনির ওপরও এভাবে ছায়া ফেলত?

বেশ কাটলো সারাদিন, সেদিন আর ফেরা হোল না, ঠিক করলাম পরদিন একটু ঘুরে
ফিরে এর -তার সাথে দেখা করার কাজটা সেরে নেব। আঁখি বললো সারাদিন সঙ্গ দেবে। সুবিধাই হোল। রাতে খেতে বসে নীলই প্রথম প্রসঙ্গটা তুললো। ও নীড়ের ট্রাস্টিবোর্ডের মেম্বার, নীড়ে দু’টো সীট আছে যে দু’টো স্পনসরশীপের ওপর চলে। অনেকেই আছেন যাঁরা এই সংস্থায় মাসিক আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকেন। আর্থিক সঙ্গতি আছে এমন চেনাশোনা সবার কাছেই খুব সামান্য অনুদান চাওয়া হয়। তারপরে কে দেবে আর কে দেবে না সে তাদের ব্যক্তিগত
সমস্যা। বললাম-
- আন্দাজ কি রকম দেয় লোকে?
মুখে ভাতের গ্রাস তুলতে গিয়ে হেসে ফেলে নীল বললো-
- তার কোন ঠিক আছে নাকি? ৫০ থেকে ৫০০, বেশী কম ও হয়, কতলোক তো দেব বলেও
দেয় না,কেউ এক দু’বার দিয়েই বন্ধ করে দেয়।ঠিক আছে নাকি?তোকেও জোর করছি না মিষ্টু, ইচ্ছা হলে দিবি, ইচ্ছা না হলে দিবি না, আর দিসই যদি কত দিবি সেটা তুই-ই ঠিক করবি, আমরা নাক গলাবো না।
আঁখি বললো-
- একটা কাজ করি মিষ্টু, আজ তো এখানে নীড়ের সবে উদ্বোধন হল, আবাসিকরা সবাই আসে নি। কাল চল তুই আর আমি বরঞ্চ ওদের নিমতা শাখাটা দেখে আসি। আগে কত ঘনঘন যেতাম, আজকাল নীলেরও সময় হয় না আর আমারও কলেজের ফাঁকে সময় পাই না। দাদুভাইয়ের অসুখটাও এমন সময়ে হল, দাদুভায়ের এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রথম ওখানে যাওয়া, এত ভালো লেগেছিল না রে মিষ্টু, রবিবার আসলেই মন টানতো। নিজের চোখে দেখার পরে নীড় সম্বন্ধে কিছুটা বেশী জানতে পারবি।

সাধু প্রস্তাব, কাল আমারও দারুন জরুরী কোন কাজ নেই, তো রাজী হয়ে
গেলাম। তা হলেও ঘুরে ফিরে কাজ মিটিয়ে নীড়ের নিমতা শাখায় পৌঁছতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে এল। দোষটা আমার নয়, আঁখি প্রায় মাস সাত আটেক পরে ওখানে যাচ্ছে বলে সবার নামে নামে খুটখাট ছোটমোট জিনিষ কেনাকাটি করেছে আর আমায় এ দোকান থেকে সে দোকান ঘুরিয়ে মেরেছে। আকাশ জুড়ে সেদিন জোৎস্নার ঢল নেমেছে, লোডশেডিং চলছিল বলে আরও ভালো লাগছিল জোৎস্নাটা। দেখতে দেখতে চাঁদ ছাপিয়ে উড়ে এল দামাল কালো মেঘ। চারপাশটা আরো অন্ধকার করে ঝেঁপে বৃষ্টি এল।

ছোট্ দোতলা বাড়ী, শান্ত পরিবেশ, অন্ধকারে বিশেষ কিছু আর দেখতে পেলাম
  না। ফিসঘরে একজন রোগা চেহারার হাসিমুখের ভদ্রমহিলা এমারজেন্সি লাইট জ্বেলে বসে ছিলেন। আঁখিকে যেভাবে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন, বুঝলাম, ভালোই চেনেন। এটাসেটা দু এটা কথা বলে আঁখি বললো,
- ওঠ মিষ্টু, সবার সাথে দেখা করে আসি।
বলে ওর সারপ্রাইজ গিফ্টভরা ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা দিল, পিছন পিছন আমিও। ওর তালিকা থেকে একজন মারা গেছেন, দু’জন আপাতত হসপিটালাইজড, একজনকে প্রবাসী মেয়ে এসে বাড়ী নিয়ে গেছেন। তিনজনকে শারিরীক কারনে অন্য শাখায় পাঠানো হয়েছে। দু’জন নতুন এসেছেন। ঘুরতে ফিরতে হাসিদি (আসল নামটা জানি না) খবরগুলো দিলেন। দুজনের একজন রয়েছেন সেই স্পনসরড সীটে, খুব অসুস্থ, বিনাচিকিৎসায় কোন এক সরকারী হাসপাতালের বারান্দায় ধুঁকছিলেন, সহৃদয় কেউ এখানে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। লম্বাটে একটেরে  ঘরে পরপর ছয়জনের থাকার ব্যাবস্থা। একদম দেওয়াল ঘেঁষে জানলার পাশের বেডটায় যিনি শুয়েছিলেন তাকে দেখিয়ে হাসিদি কথাগুলো বললেন। আমরা পাশে গিয়ে দাঁড়াতে খুব ক্ষীন কাঁপাকাঁপা স্বরে বললেন -
- যাও তো, জানালাটা খুলে মোমবাতিটা নিভিয়ে দাও। জ্যোৎস্না আসুক।”
- বড্ড বৃষ্টি বাইরে মাসীমা, আর মশাও ঢুকবে যে, -নরমভাবে হাসিদি বললেন।
-“জানালা দিয়ে এখন বৃষ্টি ভেঙ্গে নেমেছে লাগছে! সেটা আবার ঝপঝুপে শব্দের মাঝে! বড় অদ্ভুদ সে দৃশ্য। ভগবানের অমর সৃষ্টি, মানুষের আয়ূ আর কদিন? যা পারি দেখে নিই।”
সরে যাচ্ছিলাম, শুনতে পেলাম আপনমনে উনি বলছিলেন-
-“রোদের মাঝে যেমন বৃষ্টি নামে, তেমনি জ্যোৎস্নার মাঝে বৃষ্টি নামে নাকি? দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। এক সাথে বৃষ্টি আর বাঁধভাঙ্গা জ্যোৎস্না....এ জীবনে আর দেখা হল না।”
“এক সাথে বৃষ্টি আর বাঁধভাঙ্গা জ্যোৎস্না.”???? বড্ড চেনা কথাগুলো, কোথায় যেন শুনেছি, ঠিক মনে পড়ছিল না, বাইরে সজোরে বিদুৎ চমকালো, লাইটগুলোও জ্বলে উঠল। আমরা দুজন একসাথে পিছিয়ে এসে ঝুঁকে পড়লাম ভদ্রমহিলাকে ভালো করে দেখতে।
- প্রভা দিদিমনি? এ কি চেহারা হয়েছে আপনার?
স্কুলে আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষিকা ছিলেন এই প্রভা দিদিমনি । আমাদের কি সুন্দর করে যে বাংলা পড়াতেন, কঠিন প্রশ্নগুলোর উত্তর কি সরলভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে বাড়ী গিয়ে আর মানেবই পড়র দরকার পড়ত না। অথচ মাধ্যমিকের ঠিক আগে কাউকে কিছু না বলে কেন যে আসা বন্ধ করে দিলেন জানিনা। পরে কানাঘুষোয় শুনেছিলাম পারিবারিক কারণে নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়ীর লোকে ওনাকে মানসিক রুগীদের হাসপাতালে ভরতি করিয়েছিল এবং উনি সম্ভবত ওখান থেকে কোথাও চলে গেছিলেন। অবিবাহিত প্রভা দিদিমনিকে আমরা সবাই খুব মনে করতাম। পরে সময়ের সাথে তিনিও ধূসর পান্ডুলিপিতে ছবি হয়ে ছিলেন। আজ সেই পান্ডুলিপির ধূসর পাতা খানিকটা ধূলো উড়িয়ে জানান দিলো, যে, আমি আছি।আমরা চিনলেও উনি কিন্তু আমাদের চিনতে পারলেন না। ওনার স্মৃতি, ওনার
বোধ, ওনার চিন্তা, পারিপার্শ্বিকতা আর কোনদিনই বর্তমানে ফিরবে না।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফেরত এলাম। আঁখিকে বললাম, দিদিমনির খরচাটা আমিই
  দেবো। অন্য কারো কাছ থেকে নেবার দরকার নেই। আমার পক্ষে তো আর থাকা সম্ভব নয়, আমার হয়ে আঁখিই যেন যা যা করনীয় সেটা করে আমায় খবর দেয়।

আমি গুরুদক্ষিণা দেবো ভাবলেই তো হল না, হয়ত গুরুদক্ষিণা দেবার যোগ্যতাও
সবার থাকে না।অন্তত আমার হয়তো নেই, ফেরার পথে রাস্তাতেই মোবাইলে আঁখির থেকে শেষখবরটা পেয়ে গেলাম।

এবার থেকে আমি জোৎস্নারাতে বৃষ্টি নামলেই জানালা দিয়ে জ্যোৎস্নার মাঝে
টিপটিপ বৃষ্টি নামা দেখবো। কারন আমি জানি ভরা জ্যোৎস্নায় কোনো অপূর্ণতা থাকে না।
 
 

রত্নদীপা দে ঘোষ


এক সন্ধ্যা

দুপুরের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল আচমকা আওয়াজে। ঘুম এতো গভীর ছিল যে কিছুক্ষণ দেবারতি বুঝতে পারলেন না এখন সকাল না বিকেল। অতঃপর মন ফিরলো নিজ নিকেতনে। ঘড়ির দিকে চোখ। বিকেল চারটে বাবুই আর পিয়ালি অফিসে। নীচের তলায় সম্ববত নতুন ভাড়াটেরা জিনিসপত্র গোছাচ্ছে, সকাল বেলাতেই ওদের মালপত্র এসে গিয়েছিল।

আসলে বাবুই আর পিয়ালি দুজনেই অ্যামেরিকা চলে যাচ্ছে। তাই নীচের তলাটা ভাড়া দেওয়া। বাবুই ঘ্যামা একটা জব পেয়েছে মেরিল্যান্ডে। এমনি ভাষা বাবুই পাখির। পিয়ালি এখনো কিছু পায়নি। তবে একবার সেখানে গিয়ে পড়তে পারলে পেতে কতক্ষণ। সমস্ত প্ল্যান বাবুই নিজেই ঠিক করেছে মায়ের জন্য, বাড়ীর জন্য নিজেদের জন্যতার একদম ইচ্ছে নয় যে তারা দুজনে চলে যাবার পর মা এই দোতলা বাড়ীতে একলা থাকুক। দেবারতি বহু পুরানো অ্যাস্থমা রুগী। তাছাড়া প্রেসার ও হাই এর দিকেবাবুই নিজেই ওল্ড হোমের আইডিয়াটা দিলো। এসব গত তিন মাস আগেকার ঘটনা। বাবুইরা নিজেরা দুজনে অনেক ওল্ড হোম ঘুরেছে কথা বার্তা বলেছে অবশেষে গোটা তিন চার ফাইনাল করে মায়ের দরজায় হানা। মায়ের থাকবার জায়গা মায়ের পছন্দ মতই হবে।

একটা রোববার দেখে তিনজনে বেরলেন। প্রথমটার নাম আশালতা। বেশ বড়ো, তিনতলা, একটু প্রাচীন গন্ধ। এই গন্ধটাই দেবারতির পছন্দ হোলো নানিজেকে পুরনো মানুষ ভাবতে তিনি রাজি হলেন না। নাম্বার টুটা জাস্ট ফাটাফাটি । বাবুইর মতে । পিয়ালির ভাল লাগ্ল ঘরের লাগোয়া ব্যালকণিটা । একদম এইটুকু । আর ঘরটার রঙ হাল্কা নীল । দেবারতির মনে হোলো ঠিক এই রকম একটা নীল রঙ কোথায় যেন ...একটু শীত , শালটা টেনে নিলেন গায়ে । দেবারতি এই বৃদ্ধাবাসটি পছন্দ করলেন

নীচের তলায় আসবাবপত্র টানাটানির আওয়াজ হচ্ছে , কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে । বসবার ঘরে টিভিটা অন করে এক কাপ চা । রোজগেরে গিন্নী প্রোগ্রামটা এই সময় প্রতিদিন দেখেন দেবারতি । একটু পরেই রান্নার ছেলেটি আসবে । আজ বাবুইরা পার্টি তে যাবে , রাত হবে ফিরতে ওদের । সবে নতুন গিন্নীর সাথে আলাপ হোলো কি হোলো না বেল বাজলো । দরজা খুলে দেখলেন বাচ্চা একটি মেয়ে এই বছর পাঁচ বয়েস আর সম্ভবত সাথে ওর মা । তার বয়েস মনে হয় পিয়ালির মতই ।
নমস্কার , আমরাই নীচের তলায় এসেছি । আমার নাম মল্লিকা আর এ আমার কন্যা ধানসিঁড়ি । আপাতত আমরা তিনজন থাকবো , দিন কুড়ির মধ্যে আমার বাবাও এসে যাবেন । চার জনের সংসার আমাদের , আমরা দু বোন , বাবা কখনো দিদির বাড়ী কখনো আমাদের সাথে থাকেন দেবারতি বাচ্চাটার গাল টিপে দিলেন । মা মেয়ে দুজনেই খুব বকবকে । কি মিষ্টি মেয়ে তোমার আর নামটাও ভারি সুন্দর রেখেছ... তোমরা যখন বাড়ী দেখতে এসেছিলে তখন আমি হরিদ্বারে ছিলুম বোনের বাড়ীতে , তাই দ্যাখা হয়নি আগে ।
হুম। মল্লিকা বললো , তাই তো আলাপ করতে এলুম । আপনিও তো চলে যাচ্ছেন ... হু, যাচ্ছি বৃদ্ধাবাসে । দেবারতি হাস্লেন , আসলে আমার ছেলে পছন্দ করছে না আমি বাড়ীতে একলা থাকি , আমি অনেক বোঝালুম যে নীচেও তো লোকজন থাকছে ... কিন্তু ছেলে রাজী হোলো না , আসলে আমার শরীরটাও ভালো যায়না তেমন ... বৃদ্ধাবাসে অনেকের মাঝখানে থাকা , কথাবার্তা আড্ডা এগুলো জরুরি তাছাড়া নিয়মিত ডাক্তারের চেক আপের ব্যবস্থাও আছে সেখানে ......ছেলে মেয়ে বড়ো হয়ে গেলে তাদের কথা শুনেই চলতে হয় ।
মল্লিকা বললো , কিন্তু থাকলে ভালো লাগতো আমাদেরও , দেবাশিস তো বেশীর ভাগ সময় ট্যুরেই থাকে , আমি বাবা আর মেয়ে । সুধাংশুর ছবিতে চোখ আটকেছে মল্লিকার । দেবারতি কবে ছেড়ে এসেছেন পঁয়তাল্লিশ । কিন্তু মেহগিনি ফটোফ্রেমে সুধাংশু এখনও চল্লিশ , ঝকঝকে যুবক । চশমার ফ্রেম আঁচলে মুছলেন দেবারতি , তোমার মেশোমশাই , আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বহু বছর ।
মল্লিকাও বিষণ্ণ হোলো , আমার মাও অনেকদিন চলে গেছেন । আমার বাবাকে আপনি চিনলেও চিনতে পারেন । বাবা নতুন চাকরি পেয়ে যখন কলকাতায় আসেন তখন এ পাড়াতেই কোথাও ভাড়া থাকতেন । আমরা এখানে আসছি শুনেই বাবা খুব খুশি , বললেন সেকিরে , আমারি পুরনো পাড়া ...
আজ আসি মাসীমা ... পরে আবার আসবো । দেবারতি বললেন , এসো আবার বরকে , বাবাকেও নিয়ে এসো ... তোমার বাবার নাম কি ? নিখিল প্রামানিক ... মল্লিকার মেয়ে ছুটছে ... মল্লিকাও

একতলার ঘরের রঙ তখন ছিলো নীল । আজকেই সুধাংশুর রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন কি ভাগ্যিস সুধাংশুর অপেক্ষা না করে দেবারতি একলাই গিয়েছেন রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে । চেম্বারে বসে কাঁপছেন দেবারতি ... চোখের দিকে তাকিয়ে ডঃ সেন বলছেন , আপনারা অন্য কিছু ভাবুন না ... অ্যাডপ্ট করতে পারেন ... বা অন্য কিছু ... রাতে সুধাংশুর বুকে হাত রাখলেন দেবারতি । থ্যাঙ্ক গড , আমরা দুজনেই একদম নর্মাল ... আমার মন বলছে ... দেখো হয়তো সামনের মাসেই ...

পরের মাসে সুধাংশু তখন ট্যুরে । রাত নটা নাগাদ একতলায় । কলিং বেলে হাত রাখলেন দেবারতি । ঘরময় নীল , ব্যাচেলারস ডেন । অগোছালো শার্ট প্যান্ট আন্ডার গারমেন্ট ছড়ানো বিছানায় ... দেবারতি হাত রাখলেন নিখিলের ডেনিমে ... আঃ এতো নীল কেনো ...

বাবুইপাখি অবশ্য খুব ফর্সা , নীল শিরাগুলো উঁকি দ্যায় কখনো চামড়ার ফাঁক দিয়ে ।লোকে বলে ছেলে নাকি সুধাংশুর রঙ পেয়েছে আর নাক চোখ দেবারতির ।

বৃদ্ধাবাসে যাবার বেশী দিন বাকি নেই । টুকটাক জিনিসপত্র এরই মধ্যে গুছিয়ে ফেলেছিলেন দেবারতি , পছন্দের শাড়ি , গল্পের বই , অতুলপ্রসাদের সিডি ... নিজের বিয়ের একটা ছবি , বাবুই আর পিয়ালিরও
খুব দ্রুত দেবারতি জায়গার জিনিস সব জায়গামত গুছিয়ে রাখলেন ... বই, শাড়ি সিঁদুরদানের ফটোটাও বেরোলো অ্যামেরিকান ট্যুরিস্টার থেকে ... আঁচলে ছবিটা একবার মুছে শোবার ঘরের ছোট টিভির মাথায় রেখে দিলেন যেন আর কোত্থাও আর যাবার নেই তার ।

ছোট থেকেই সব্বাই জানে দেবারতি খুব গোছানো স্বভাবের মানুষ ।