কবিতার পরিবারের একমাত্র ব্লগজিন

এখনও পর্যন্ত  Website counter  জন ব্লগটি দেখেছেন।

শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ২য় বর্ষ ২য় সংখ্যা

সম্পাদকীয়


পুজো এসে গেল, আকাশ মেঘমুক্ত হতে না চাইলেও শারদীয়া আনন্দে মেঘের পেঁজাতুলো, ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি, কাশবনে বাতাসের ঢেউ খেলে যাওয়া এসবের মধ্যে মা আনন্দময়ীর আগমনী বার্তা, পাশাপাশি পবিত্র ঈদ উল্ আজহার উৎসবের আনন্দ। আর সাহিত্যপিপাসু বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়লো পুজো নিয়ে। শারদীয়া পত্রিকা আনন্দ প্রকাশের একটা মাধ্যম, পড়তেই হয়, লিখতেই হয়, নইলে কিছু একটা হয়নি হয়নি ভাব। পূজার অবিচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক অঙ্গ। ধারাপাতি কিংবা ধ্রুপদী সাহিত্যের সাথে আনকোরা কবিও মিলে যান আনন্দে সামিল হতে। ভাবখানা এই ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে আমাদের এই আনন্দ ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে হবে। বিপুল নস্টালজিয়ার ঘনঘটা।

এতো পড়েছি যে আমি ও দু চারটে অমনি লিখে দিতে পারি চোখ বুজেই। ছেলেবলার কথা মনে পরে তো লিখে দিলাম। মন ভালো লাগছেনা তো লিখে ফেললাম । কাশবনে রয়েছি একটু ভাবলাম, মূর্তি গড়া দেখছি চন্ডীতলায়। মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে ক্ষ্যান্ত পিসি ফল কাটছেন , গরদের শাড়ী পরে মা নৈবিদ্য সাজাচ্ছেন, আতপ চালের গন্ধ, ধুপের গন্ধ পেলাম নাক ভরে - লিখে দিলাম। বাড়ী ময় ম ম করছে লুচিভাজা সুজির পায়েসের সৌগন্ধ। স্মৃতিকথা বেরিয়ে আসে মনের মনিকোঠা থেকে। পড়েছি কতবার, লিখেছিও কিন্তু পুরনো হয় না। পুরনোকে নতুন করে পাবার আকাঙ্খা, নিজেকে সাহিত্য দর্পনে দেখা, একটা আঙ্গিক তৈরী করতে অন্তর্জাল মাধ্যম। আপনারা পড়েছেন অনেকবার, নিজেরাই লিখেছেন অনেক বেশী। অন্তর্জাল মাধ্যমকে সাহত্য চর্চার মাধ্যম হিসেবে অনেকেই মেনে নিতে চান না। মনে একটা প্রশ্নও আসে এত কবিতা এত লেখা - সাহিত্য চর্চার মূলস্রোত বেনোজলে ভেসে যাবে না তো? অথচ সবচেয়ে প্রানবন্ত মাধ্যম - কত মানুষের হাসি কান্না সুখ আনন্দ, বৃত্তের থেকে বেরিয়ে আসবার প্রচেষ্টা - অদম্য আগ্রহ নিজের সৃষ্টিকে প্রসবিত হতে দেখবার। আর এই সন্তানতুল্য সৃষ্টিকে তাৎক্ষণিক উপহারে ভরে যেতে দেখবার মধ্যে এক সুখ অনুভব - আমার মনে হয় প্রবীণ - নবীন, কবি অকবি, পাঠক, কেউ মেধাবী কেউ বালখিল্য সকলকে মিলে ও মিলিয়ে এ এক জীবন্ত ক্ষেত্র। কবিতা, গল্প, চিন্তা, প্রবন্ধ, ভ্রমনকাহিনী , ছবি আঁকা, কি নেই?

প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলেও কোনো অভিমান নেই, সৃষ্টির অনাবিল আনন্দে দুর্বার এগিয়ে চলা । সহজাত দলবদ্ধতার মানসিক তাগিদ এখানেও কিছু গ্রুপ, চক্র, সংহতি এসবের সৃষ্টি করেছে । কবিতার পরিবার প্রায় চার বছর ধরে এক অনবদ্য মিলনমেলা। প্রাণের উচ্ছাস একে এক অতুলনীয় উচ্চটাতে তুলে ধরেছে। ধাপে ধাপে উত্তরণ ঘটেছে - সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কবি ও সাহিত্যিক সুমিত রঞ্জন বাবু-র নিষ্ঠা ও সিদ্ধার্থ শর্মার প্রাণপ্রাচুর্যে ‘পারিবারিক’ ব্লগ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়ে আসছে। অনেক মানুষ লিখেছেন, নিজে পড়ুন ও অপরকে পড়ান, উৎসাহ দিন। সাহিত্যমনের বিবর্তনের সাক্ষী থাকুন। জীবনযাপনের অন্য নাম হোক সাহিত্য আলাপন। আসুন সহায় সম্বলহীন মনকে আস্তাকুঁড়েতে নিক্ষেপ না করে সকল অনুভবকে সাহিত্যে রূপ দেই। মন্ত্রোচ্চারণের সাথে সাথে জীবনযাপনের মধুরিমা পথে আলোকবর্তিকা হিসেবে, মন মানসে পদ্ম হয়ে প্রস্ফুটিত হই। কবিতার পরিবারে একান্নবর্তী পারিবারিক সান্নিধ্যে সুখী হই। প্রশান্তি ছেয়ে যাক। কবিতার পরিবারের সকলকে শারদীয়া পূজা ও ঈদ উল্ আজহার শুভেচ্ছা । ভালো কাটুক জীবন, ভালো থাকুন , ভালো রাখুন।


শুভেচ্ছান্তে -
পারিবারিকের পক্ষে জয়ন্ত সাহা।



ধারাবাহিক - সিধ শর্মা

নিলু - সীমান্ত
সিধ শর্মা


পর্ব -১

কাল সারারাত চোখে ঘুম নেই নিলুর। পইপই করে বারণ করা সত্যেও সেই অফিস কাফেটেরিয়াতে লাঞ্চ করেছে। ইন্ডিয়ান স্পেশ্যাল - স্বাধীনতা দিবসে কয়জন ভারতীয় মিলে একসাথে খাবার খেয়েছে। কে যে হাবিজাবি খেয়ে এসেছে। সন্ধ্যেতে ফিরেই অস্বস্তি - পেটে যন্ত্রণা। রাত বাড়তেই সীমান্ত ধীরে ধীরে কাহিল -

"নিলু খুব দুখছে পেট!"

কি করলে কি ঠিক হবে ভেবে পায়না নিলু। বড়ে ভাইয়াকে দিল্লীতে ফোন লাগায় - ভাইয়া ঘুমে। ..ভাবী ধরতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে নিলু "কি করবো আমি এখন ভাবী ? ও যে আমার কথা কিছুই শোনে না। ..."

এরপর মেডিসিন - রাতভর শুশ্রুষা চলতেই থাকে। সীমান্ত ভোরের দিকে একটু ঘুমায়। স্বপ্ন দেখে -

সেই প্রথম দিককার কথা। সেও ছিল একটা স্বাধীনতা দিবসের ছুটির দিন। নিলু ওদের দেশের বাড়িতে নিয়ে গেছিল সীমান্তকে।সবুজ গাছগাছালি ভরা মনে হয় যেন সারা পৃথিবীটাই সবুজ রঙের তার মধ্যে একটা মাটির বাড়ি খড়ে ছাওয়া চাল - ভেতরটা কি সুন্দর ঠান্ডা। নিলু ওকে টেনে নিয়ে যায় হাত ধরে একটা গভীর দিঘী - বর্ষায় টইটুম্বুর ভরা যৌবনা কলসি ভরা সুখ - ওর সিঁড়িতে বসে নিলু জলে পা ডুবিয়ে ছলাত ছলাত শব্দ তোলে। নিলুর নরম পায়ে সীমান্ত পা লাগিয়ে বসে থাকে গায়ে গা ঘেঁষে। একটু দূরে সবার আড়ালে-জলে ভেসে থাকা একটা পদ্মকুঁড়ির ডগায় একটা ফড়িং-টকটকে লাল - যেন সীমান্ত ছোঁয়ায় নিলুর লাজে রাঙা মুখখানি। নিলু - সীমান্ত আর ওই ফড়িং - তিনজনই খুব সুখী তখন - আকাশ ঘন নীল- উড়ে উড়ে যাচ্ছে সবুজ টিয়া - ঘুরে ঘুরে মাছরাঙ্গা বসছে মাছের আশায় - ওই টিয়া - ওই মাছরাঙ্গা - আর সীমান্ত সকলেরই ঠোঁট লাল। ..

আষ্টেপিষ্টে কলতানে
গহীন সুখ সন্ধানে
রোমে রোমে চুম্বনে
ঠোঁট ভরে সুখ;
নিলুসুখ বাহুলতা
খুলে দিয়ে দ্বিধার ফিতা
ওষ্ঠ ডুবে থাকে
গভীর ভরাট বুক। ....সীমান্ত সাহসী হয়

"হ্যাট!" এখন না ....নিলু লজ্জায় রাঙা
"ক্যানো ?"
"ওই ওরা দেখছে না!"
"কারা ?" সীমান্ত পেছন ঘুরে দেখে -
"ওই যে ওরা" নিলু ফড়িং আর মাছরাঙ্গা দেখায় আঙ্গুল তুলে।

উফ! কিভাবে কেটেছিল সময় - কেমনে সুখস্বর্গে ভেসে গেছিল দুটি মন - সীমান্ত স্বপ্নের মধ্যেই হাসে।

নিলু বোঝে সীমান্ত স্বপ্ন দেখছে - তার মানে ওর ব্যথা একটু কমের দিকে। সীমান্তর ঠোঁটে উবু হয়ে একটা চুম্বন এঁকে দেয়....

বিহবলা রজনী
বয়ে চলা তটিনী
সুখ মন্দাকিনী
তির তির ধারায়। .....

সীমান্ত স্বপ্ন দেখেই চলে - নিলু হঠাতই দুহাতের বাঁধন থেকে পালায় ঝপ করে - শাড়ীটা গাছকোমর বেঁধে নেমে যায় ওই দিঘীতে ঝপ ঝপ ছলাৎ ছলাৎ - একটা উজ্জ্বল রাজহংসী গ্রীবা তুলে সীমান্তকে চোখের ইশারায় ডাকে -

"চলে এস!"

মন্ত্রমুগ্ধের মত সীমান্ত জলে নেমে যায় - খেয়ালই থাকেনা ট্রাউজার শার্ট খোলা হয়নি। হাত ধরে নিলু টেনে নেয় গভীরে। কি ঠান্ডা জল।..

"এই তু...মি সাঁতার জানো তো?"
"উহু"
"তালে নাবলে কেন? আমাকে জড়িয়ে রাখো"

আহা! নিলু বলছে জড়িয়ে থাকতে! তখন প্রথম দিককার কথা - নিলু অত সহজ হতে পারতনা - কিন্তু এই সময়ে কত সহজে বলে দিল "আমায় জড়িয়ে থাকো! আরে! পাগলি! তোমাকেই তো জড়িয়ে থাকবো সোনাল আজীবন।"

সীমান্ত একটা ডুবকি লাগায়। কেউ দেখতে পাচ্ছেনা এখন কোমর জড়িয়ে সীমান্ত।

"এই! ধ্যাত!" "বেশি অসভ্যতা করবে না কিন্তু!"

সীমান্ত উঠে পড়ে - অন্যদিকে মুখ ফেরায়। "বেশ"

"কি হোলো ! বাবুর রাগ হয়ে গেল? রাগ যেন একদম নাকের ডগায় লেগে থাকে!" বলে নাকটা আঙ্গুল দিয়ে ঘষে নাড়িয়ে দেয় নিলু।

"তবেরে!" সীমান্ত নিলুকে জড়িয়ে ধরে ......... উমমমমম ........

জাপটা জাপটি ঝাপটা ঝাপটি আর খিলখিল হাসির জোয়ারে পানকৌড়িগুলো দল বেঁধে একসাথে উড়ে পালালো - মাছরাঙ্গা বিরক্ত হয়ে তাকালো "ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ মাছটা ডুব মারলো বলে" শুধু বাতাস একটু মুচকি হসে বলে গেল "আমি কিছু দেখছিনা"

নিলু বুকে লেপ্টে - একটু চোখের শাসন দিতে চেয়েছিল কিন্তু পারে না - ওই জলে মিশে যাওয়া রঙ ওই স্বপ্ন ওকে মাখিয়ে দিয়ে বাধ্য করে বলতে -

"নাও জলে ডুব দিয়ে স্বপ্ন দেখে নাও - যা খুশি - যেভাবে খুশি তোমার নিলুকে আদর করে নাও প্রানভরে কিচ্ছু বলবনা - আজ তুমি স্বাধীন।" ...

অনেকটা সময় পানিতে-দুজনে, ডুবেছে - ভেসেছে -আকাশে মুখ-চোখ বুজে-লাল, নীল, বেগুনী স্বপ্ন-মনে হচ্ছিল যেন আকাশটা অনেক নিচে নেমে আসছে- রঙধনু মেলে। ...কী যে অদ্ভুত লাগছিল..

সীমান্ত অস্ফুটে বলে ওঠে। .."নিলু" "আমার নিলু"

চোখ লেগে আসা নিলু শুনতে পায় ওঠে ধরমড়িয়ে "এই কি হচ্ছে? কষ্ট হচ্ছে সোনাবাবু? আমার সীমন !"

"না তো! তুমি সারারাত জেগে? সীমান্তর ঠোঁট ভরে হাসি ...

ভোর হোলো - প্রভাতের সূর্যোদয়কে স্বাগত জানাতে সারারাত ঝড়ে বিদ্ধস্ত পাখিটা কলকল করে গেয়ে ওঠে আনন্দগান -

আমার রাত ফুরোলো নিবিড় সুখ সন্ধানে
লজ্জাহীন বৃষ্টির ফোঁটা প্রতি স্পন্দনে
অপেক্ষা হল অবসান।
নির্মল ভোর তুমি আমি আছি পাশাপাশি
এই সুখসদনে। .....

নিলু মোবাইল টিপে কলকলিয়ে বলতে থাকে। ..."হ্যালো ভাবী ও ভালো আছে। আর চিন্তার কিছু নেই গো ...দিদি." 


গল্প - সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

নিভৃতে যতনে
সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়



এই কাহিনীতে “প্রথমে মোহাবেশে, বর্ণ বৈচিত্রে প্রেমের বন্ধন তারপরেই সহজ সত্যের স্ব স্ব সালংকৃ্ত মহিমায় প্রবুদ্ধ মনের কাছে তার পূর্ণ বিকাশ।”


****

সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে আছে সব চেয়ে উঁচু টিলাটাতে। আর প্রকৃ্তির পেয়েলায় চুমুক দিয়ে দেখছে বাইরে-

শীত একটু একটু করে ঝুলি নিয়ে আসতে শুরু করেছে। পাহাড়ের মাথায় জল ভরা মেঘের ভাঁড়। উঁচু উঁচু পাহাড়্গুলোর ছায়ারা গাড় রঙের সাজে লম্বা হতে হতে আঁধারের রূপ নিয়েছে। উপত্যকার পায়ের নূপুরে একটু একটু করে শিশিরের রিনিঝিনি জমতে শুরু করেছে। প্রকৃ্তির ছেনির কাজ না দেখলে রসগ্রহণ করা যায় না।

এমনি এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থ অবাক হয়ে প্রকৃ্তিকে দেখছে। পঁচিশটা বসন্তের আগেও যে দেখেনি তা নয়, তবে এ পাহাড় যেন এক নেশার পাহাড়। অদ্ভুত এক সন্মোহনী পাহাড়কল্প। চারিপাশে সবুজের ঘনঘটা। তির তির করে বয়ে চলেছে শান্ত নদী বিয়াস। অসংখ্য হট স্প্রিং। মাঝে মাঝে উপজাতিদের বাঁশ আর কাঠের তৈ্রী ঘর, ঠিক যেন পটে আঁকা ছবি। প্রকৃ্তির দৌ্রাত্ম পাহাড়ের গায়ে আদিম সৃষ্টির রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। এই উদ্ধত ছবি যে কোন প্রকৃ্তি প্রেমিককে বাঁধতে পারে আস্টে পিস্টে। এইসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে সিদ্ধার্থ হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে আর শুনতে পায় খিল খিল হাসির শব্দ -

“ ও বাবু ক্যয়া পথ হারাছি নাকি, পথ দেখি না চলছ্”- নারী কণ্ঠস্বর যেন আরো কাছে এসে বললঃ -“এ শুনসান পাহাড়ে তু একেলা ক্যা করছ্”-

ও ভূত দেখছে না তো। সামনে দাঁড়িয়ে এক মূর্তি, খালি ঠোঁট নড়ছে তার। গোলগাল চেহারা, চাপা নাক, আঁটোসাঁটো গড়ন, টলটলে চোখে বাঁকা ভুরু। এক পিঠ কোঁকড়ানো চুলের একটা দুটো চলে এসেছে অজান্তে ওর গোলাপী গালের ওপর। ফারসাহী রংয়ের আঁকিবুঁকি লুঙ্গি। আর তার সাথে জলপাই রঙ্গের জামাবন্ধ। রূপোর কানের দুল কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে গেছে। মাথায় টায়রা কপাল জুড়ে। একটা লম্বা গোলাপী রঙ্গের উড়নি দিয়ে মাথাটা ঢাকা। কোমরে বাঁধা রূপোর চন্দ্রহার। সিঁদুরে মেঘে কি যেন এক মোহিনী মূর্তি এঁকে দিয়েছে বিচিত্র মোলায়েম ছবি।

দূরে কোথাও মন্দিরে তখন গুরুগম্ভীর স্বরে বেজে চলেছে-

বুদ্ধং শরনং গচ্ছামি।

ধর্মং শরনং গচ্ছামি।।

সঙ্ঘং শরনং গচ্ছামি।।।

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, একেই কি বলে “লাভ এ্যট ফার্স্ট সাইট”- শেষে নিজের স্তম্বিত ফিরে পেয়ে বললঃ

-আমি সিদ্ধার্থ। এখানে প্রথম বেড়াতে এসেছি।

-'সিধা' বলেই এক খিল খিল হাসি ছড়িয়ে চলে যাচ্ছিল-

জিগেস করলাম,- “তোমার নাম কি?”

-'পিংকাঙ' এখানেই থাকি। বলেই, না দাঁড়িয়ে পাহাড়ী ঝর্নার মতন এঁকেবেঁকে মিলিয়ে গেলো সবুজ ঘন আঁধারে। মাথার উড়নিটা হাওয়ায় ভেসে ভেসে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল যেন ওকে পেছন পেছন আসতে বলছে। ওর মিসটি হাসির প্রতিধ্ব্নি কানে এসে ঢুকল।

ভাবল তাই তো, হিমাচলেই তো কিন্নর দেশ। অনেক মেয়ে দেখেছে - কিন্তু এই মেয়ে যেন মনে শিস্ বাজিয়ে গেল।

একটা উঁচু টিলায় বাড়ী ভাড়া করেছিল সিদ্ধার্থ। চারিদিকে আপেল বাগান আর লাল, কমলা, হলুদ, বেগুনী ফুলের সমারোহ। বারান্দায় বসে আছে আর দেখছিল কেমন করে প্রকৃ্তির রূপ পান করছিল এক সুন্দর শান্ত সকাল। সোনালী নরম রোদ আপেল গাছের ছায়াদের গায়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। নির্জ্জন সময়ে গাছে ওদের সৌন্দর্য বিলিয়ে দেয়। মানুষ না দেখলেও ওদের বয়ে গেছে। আবার চোখ চলে গেল সেই কালকের সবুজ পাহাড়ে কিন্তু একি সেই পাহাড়ী মেয়েটার কথা কেন আবার মনে এল। একটা লাল পাখি শিমূল গাছটায় ডেকে উঠল। মনে হল...সেও বলছে “মনের মেয়ে...মনের মেয়ে”। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দেখে সেই-ই কালকের পিংকাঙ আর তার সাথে আরেকটা পাহাড়ী মেয়ে।

আশ্চর্য! নামটাও মনে আছে তার। একবার শুনেই কি ভাবে মনে রাখল? ওরা ওই ফুল কুড়োচ্ছিল আর লাল আপেল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল সিদ্ধার্থ। গুটি গুটি পায়ে ওদের কাছে এল।

-আবার তোমার সাথে দেখা হল, পিংকাঙ।

চমকে উঠল পিংকাঙ পরক্ষণেই সুস্মিত হাসিতে গালে টোল ফেলে লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে উঠল। অপরূপ লাগছিল ওর মিসটি সুন্দর মুখশ্রী। চোখ না তুলেই আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, অস্পষ্ট শুদ্ধ বাংলায়।

-আমার বন্ধু কামপা, হমার ছোট্ট বেলার সাথী।

-কামপা, এই সেই সিধা... পা হররকে নীচে তলিয়ে যাইচ্ছিল কাল।

-ওহ্! মেয়ে মুচকি হেসে তাকাল সিদ্ধার্থর দিকে।

-এত ফুল আর আপেল দিয়ে কি করবে তোমরা?” ভর্তি সাজির দিকে ইংগিত করল, সিদ্ধার্থ।

-মালা গেঁথে আমার সিধার গলায় পরাব গো। আর আপেল...!-বলেই, দুই সখী অদ্ভুত হাসিতে ভেঙ্গে পরল। ওদের হাসিতে মনটায় প্রেমের জোয়ারে্র ধাক্কা খেল। ওরা বুদ্ধকে সিধাও বলে দেখছি।

এমনি সব হাসি ঠাট্টা করতে করতে ওরা যে কখন সিধ-এর কাছে এসে গেছিল, জানেনা। বোধকরি সিদ্ধার্থ নিজেও না।

ওদের সাথে ফুল কুড়াল, আপেল গাছে যে কেউ হাত দিতে পারে না সেটাও জানতে পারল ওদের কাছ থেকেই। আপেল তোলার সময় যদি গাছের পাতাও ছিঁড়ে যায় তাহলে, পরের বছর আর সেই যায়গায় আপেল হয় না, তাই খুব সাবধানে ছুঁতে হয় আপেল গাছকে।

সিদ্ধার্থ শুনে মনে মনে ভাবছে... ঠিক তোমার মতন করে সাবধানে ছুঁতে হয় পিংকাঙ।

পাহাড়ে পাহাড়ে ছুটোছুটি করল, পাহাড়ের গায়ে নিজেদের নাম লিখল, ভগবান বুদ্ধের মন্দিরে গেল, শান্ত কল্পার বুকে নৌকোয় ঘুরে বেড়াল।

ওদের সাথে যত মিশছে, তত পাহাড়ীদের সম্পর্কে ওর ভালবাসা বেড়ে যাচ্ছে। এদের কি সুন্দর সমাজ, ধর্ম, জীবন-যাপনীর রীতি সব কিছুকেই যেন ও ভালবেসে ফেলেছে। কচি নিষ্পাপ এদের মুখগুলো। আপন করে নেওয়া এক দুর্দ্দাম আকর্ষণ।

মনটায় যেন কি সব হয়ে চলেছে। ঠিক সেই হিন্দী মুভিটার মতনঃ “ কুছ কুছ হোতা হ্যায়”- টাইপের। অদ্ভুত লাগছে।

এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কামরুনাগের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চূড়োয় দাঁড়িয়ে আছে সিদ্ধার্থ আর পিংকাঙ। ওপরে ওঠার সময়ে একবার ওর ঠান্ডা নরম হাতটা ধরতে হয়েছিল।

খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে দুজনেই ক্লান্ত। পড়ন্ত বিকেলের সিঁদূরে আলো দূর পাহাড়ের গায়ে ছিটকে পড়ে কেমন বিষণ্ণ আর রহস্যময় করে তুলেছে পরিবেশটাকে। মন খারাপ হয়ে যায় পিংকাঙ-এর । উদাস ভাবে কাঁপা গলায় বলে-

-তুমি কোথায় থাইকো? কইবে ফিইরে যাবে... মুখ নামিয়ে বলল-বেশিদিন থাইকলে কিন্তু নেশা হইয়ে যাবে। এ পাহাড়ী বনাঞ্চল বড় রহস্যময়ী। বন মানুষকে আকর্ষণ করে। এ মায়ায় বেঁধে পরলে আর ফিরে যেতে পাইরবে না।

-বন মানুষকে আকর্ষণ করে কিনা জানি না, কিন্তু বনরূপার আকর্ষণতো সাংঘাতিক দেখছি। অনেকটা মুখ ফসকেই বলে ফেলে কথাটা।

মূহুর্তেই ভালবাসার রঙ্গিন প্রজাপতিগুলো পিংকাঙের চঞ্চল চোখে নেচে বেড়াতে দেখল... সিদ্ধার্থ। এ কোন মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে ও জানে না। একটা পাহাড়ী মিসটি মেয়ের না উদ্দাম প্রকৃ্তির? নিজেকে প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পেল না। শুধু একঘেয়ে ছন্দহীণ জীবনবীণায় এক অজানা সুরই শুনতে পাচ্ছে।

-সিধা কাল আমাদের বড় পরব আইছে। তুম আয়েছা দেখিনা ক্যা ভনছা' -

বলে কুমারী মেয়ের চিরন্তন অকারণ হাসি ছড়িয়ে পাহাড়ী ঢালু বেয়ে প্রায় নেচে নেচেই নেমে গেল পিংকাঙ। আর রেখে গেল এক অজানা সুর এক অজানা প্রেমের লয়। ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে কোথাও যেন উধাও হল সিদ্ধার্থ। কেউ তো এমন ভাবে মন-কে নাড়া দেয় নি? তাহলে......?

পাহাড়ী পথ বেয়ে নামতে নামতে ভাবছে সিদ্ধার্থ-কি অদ্ভুত! এ কটা দিন কি ভাবে যে কেটে গেল টেরই পায়নি। নতুন কাজে ঢোকার পর প্রথম ছুটিতে বেড়াতে এসেছে এই হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ী এলাকায়। একা... একদম... একা। কাছ থেকে নদী-সমুদ্র ও সবুজ পাহাড়ী বনাঞ্চল দেখবে বলে। সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ফিরে যেতে হবে এবার। আবার সেই একঘেয়ে গতানুগতিক জীবন। ভাবতেই অজানা বিচ্ছেদের আশঙ্কায় ছেয়ে যাচ্ছে মন। তবুও তো ফিরে যেতেই হবে। কিন্তু পিংকাঙ? ওকে ছেড়ে? ওর নরম মনটাকে কি ও আঘাত দিতে পারবে? ওকে দেখে যে শরীরে এক উদ্দাল নাচন শুরু হয়েছে সে কি আর কেউ দিতে পারবে? এরকম নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হল সিদ্ধার্থ।

দুই সখী সুন্দরভাবে সেজে বিকেলে রেকংপিতে এসে হাজির হয়েছে। কাঠের সিঁড়ি। আর কাঠের তৈ্রী মাচার ওপর টিনের ছাউনি দেয়া প্যাগোটা। আজ রাতেই বুদ্ধপূর্ণিমা। বুদ্ধের জন্মতিথি। সারা মন্দিরে ঘিরে বিরাট উৎসব। নানান মেলা শুরু হয়েছে। সে এক এলাহি কান্ড। পাহাড়ী জাতের কেউই বোধহয় বাকি নেই। সুসজ্জিত নানা পোশাকের মেয়ে-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো দলে দলে এসে হাজির হয়েছে। সারাদিন কোন কাজেই মন বসাতে পারেনি পিংকাঙ। আর সিদ্ধার্থ? চোখে মুখে রাতজাগার চিহ্ন। এতবড় উৎসবের আনন্দ ওদের মনকে ছুঁতে পারছে না।

সিধা! আর সিধা! তার বড় বড় চোখ সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। সিধাকে ভালবাসি ভাবতেই পিংকাঙের বুকের কাঁপন অহরহ বেজে চলেছে।

সামনে এসে দাঁড়ায় প্রচলিত রীতিনীতির অদৃশ্য শক্ত প্রাচীর। কামপা সখীর দুঃখ বুঝতে পারছে। কিন্তু সমর্থন করবে কি ভাবে? সামনে যে বিরাট বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে সখীর মিলন অসম্ভব-তাই বোঝাচ্ছে বন্ধুকেঃ

-পিঙ্কি, রোও না মত। তু ভুল যেইছ শকতি। মন্দিরে যা। মনজ শান্তি আয়েগা। আমরা পাহাড়ী আর তোর সিধা শহুরী।

আকাশে পূর্ণিমার বিশাল চাঁদ। যেন আলোর শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। বিয়াসের নিস্তরঙ্গ জলে চাঁদের ছায়া। বিয়াস তো নয় যেন তিয়াসা... যেন তৃষ্ণা। বিপাশা থেকে বিয়াস নামটা এসেছে। দূরে পাহাড় বনরাজি। আর মন্দিরে পাহাড়ী নর-নারীর হাস্য মুখরিত কোলাহল। সব মিলিয়ে অদ্ভুত পরিবেশ। মন্দিরটা বেশ উঁচু যায়গায়। পাহাড়ের টিলার ওপর। অনেক নাগেশ্বর গাছের ছায়ায় আবৃত। চারিদিক ফুলের মিসটি গন্ধে ভরপুর।

একটু পরেই শুরু হবে পাহাড়ীদের প্রিয় অনুষ্ঠান। রং জল আর আবীর রং খেলা। এতো যৌবনেরই উৎসব।

রবিঠাকুর বোধহয় এখানে বেড়াতে এসেই লিখেছিলেনঃ

“আমরা অদ্ভুত, আমরা চঞ্চল …

আ......মরা...আ..।।

নূতন যৌবনেরি দূত!!”

আর সবার মতো অদ্ভুত সুন্দর গোলাপী সাজে পিংকাঙ, সাদা পাজামা আর লাল রঙের পাঞ্জাবী সাজে সিদ্ধার্থ, ও তার সুবেশি সখীরাও অপেক্ষা করছে গভীর আগ্রহে।

মন্দিরের সামনে বাঁশ দিয়ে খানিকটা যায়গা ঘিরে দেওয়া হয়েছে। লাল, নীল, বেগুনী, সবুজ, কমলা, হলুদ বেলুন আর পতাকায় সাজানো মন্দির। বেশ কয়েকটা ড্রামে রঙিন জল আর এক পাশে ঢাঁই করা নানা রঙের আবীর। সামনে ঢোল-বাঁশির উল্লাস ধ্বনি দিতে দিতে আর গান গাইতে গাইতে নানাবেশি যুবক যুবতীদের একটা হাস্যোজ্জ্বল মিছিল উঠে আসছে এই ঘেরা যায়গায়।

-”চেংবা হুই চেংবা

ঢাম্পুলে আজা ক্যায়া ভন ছা-”

সিদ্ধার্থ ছোটবেলায় একটা হিন্দী সিনেমায় এরকম ঠিক দেখেছিল। এই মূহুর্ত্তে নামটা মনে করতে পারছে না। তিনদিন ধরে চলে এই উৎসব। এরই মাঝে ছেলেমেয়েদের জানাশুনা হয়। হয় মন দেয়া-নেয়া। কথা পাকাপাকি হয়। তারপর রঙিন জল ছিটিয়ে বরণ করে নেয় জীবন সাথিকে। মন্দির তো আছেই। আর আছে কামিনী ফুল।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওরা দেখছে কিভাবে ভালোবাসার লাল পাখীরা পাহাড়ী খরস্রোতা নদীর মত তরুণ-তরুণীদের চোখে চোখে নেচে ফিরছে। অকারণে ওরা হেসে উঠছে। সিধার বুক পিংকাঙের জন্য ছটফট করছে।

রঙিন জল খেলা দেখতে দেখতে আর রঙিন স্বপ্নে ওরা দুজন অনেকটা নিজের অজান্তেই কামিনী গাছগুলোর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সিধা একটু ঘনিষ্ট হতে চাইলো... ভাবছিল... একটু যদি ওর নরম শরীরটাকে নিজের শক্ত বুকে চেপে রাখা যেতো-ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কোনদিন তো কোন মেয়ের সান্নিধ্যে আসেনি বা আসবার সময় পায় নি। নিজের কেরিয়ার নিয়েই ব্যাস্ত থাকতে হয়েছে।

পিংকাঙ-এর কথায় আবার স্তম্বিত ফিরে পেল-' ক্যায়া দেইখছ'- অনেক কষ্টে ওর নরম হাতটা ধরল। হাতে একটা উষ্ণ চুম্বন এঁকে দিল। লজ্জায় রাঙ্গা পিংকাঙ কেঁপে উঠল। কেউ নেই চারপাশে। কিন্তু একটা দূরত্ব যেন গ্রাস করল দুজনকে। শান্ত হয়ে পিংকাঙ মিস্টি গলায় বললঃ

-সিধা, আমি যদি জল্ রং ছিটিয়ে দিয়ে আবিরে তোমার পোশাক রঙিন করে দি?

সিধা চোখ মেরে বললঃ “আর আমি যদি না দিই পিংকাঙ। কি হবে তখন?”

সিদ্ধার্থ জানে এই পাহাড়ী দেশের মেয়েদের বিয়ে করলে অনেক বিপদ আছে তাই পিংকাঙের কালো গভীর চোখে চোখ রেখে অনেক কষ্টে উচ্চারণ নেগেটিভ উত্তর করল সিদ্ধার্থ। পরমূহুর্ত্তেই ওর গায়ে ছিটিয়ে দিল রঙিন জল।

“তোমাকে আমি ভুইলতে পাইরব না সিধা”... বলেই আঠারো বছরের পাহাড়ী তরুণীর চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল স্ব্প্নভাঙ্গা জলের টিপ টিপ ফোঁটা। তারপর কি ভেবে বুকের আড়াল থেকে শকুন্ত পাখীর চিকণ পালক বের করে সিধার হাতে দিয়ে বললঃ

-সিধা, লাল বসন্তের শকুন্ত পাখীর নাম শুনেছ? চোখের সামনে সুখ বিলোয়। ভালবাসার ছোঁয়া লাগিয়ে মনে আগুন জ্বালায়। তারপর রেখে যায় বাঁধনের দড়ি কষে। প্রবাদ আছে- ভালবাসার কাঙাল হয়ে যারা মরে তারা নাকি শকুন্ত পাখী হয়।

সিধা পালক আমার কথা তোমাকে মনে করিয়ে দেবে নিশ্চয়ই। আমার অন্তরের সুখের স্পর্শ তোমাকে দিলাম। এ শকুন্ত পাখীর পালক হারিয়ো না কখনো।

হঠাৎ করেই নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এল ওদের মাঝে। অল্প দিনে কি যাদুতে বাধা পড়ল দুটি হৃদয়। কোন এক অজানা শিহরন খেলছে পিংকাঙের স্বপ্নের সাথি সিধার শরীরেও। মনে মনে সিদ্ধার্থ ভাবছে আর হয়ত ফেরা অসম্ভব।

কামিনী গাছের ছায়ায় ওকে জড়িয়ে ওর কাঁপা ঠোঁটে এঁকে দিল ওর ভালবাসার চিহ্ন। অনেকক্ষণ ধরে ওরা আষ্টেপৃষ্টে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে রইল, হঠাৎ একটা পাতা পরে ওদের ভালবাসার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। পিংকাঙ-এর দিকে তাকিয়ে সিধ মনে মনে গাইলঃ

-“ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে

আমারি নামটি লিখো তোমার মনেরো মন্দিরে”- পিংকাঙ-এর মাথায় নিজের হাতে ওর কাঁধে রাখা লাল চাদরটা দিয়ে একটা ফটো তুলে নিল। মাকে গিয়ে দেখাবে ওর আদরের ছোট্ট পাহাড়ী পুতুল।

ঐ পুতুল সিদ্ধার্থ হাতছাড়া করতে পারবে না কিছুতেই। মনে মনে ঠিক করল সব বাধাকে ডিঙিয়ে তার পাহাড়ী পুতুলকে চাই-ই-চাই। নিজের মা -বাবার দিক থেকে কোন বাধা আসবে না, কারণ, তারা জানেন ছেলের ভালবাসা অহেতুক না। বাধা আসতে পারে পিংকাঙ-এর দিক থেকে। তার মন বলছে, সে বাধাও হার মেনে যাবে তাদের ভালবাসার কাছে। ওর বাবা মা তো সরলভাবে অনেক ভালবেসেছে পিংকাঙের 'সিধা'-কে। মনে একটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল যখন... মন্দির থেকে গুরু গম্ভীর সুর ভেসে আসছে তখনও-

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।

ধর্মং শরণং গচ্ছাম।।

সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি।।।

******************

এই গল্পের সমাপ্তি নাহয় ন্যস্ত রইল পাঠক -পাঠিকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে।

ছোটগল্প - নরেশ মণ্ডল

মুখোমুখি
নরেশ মণ্ডল



অনেক্ষণ বসেছিলম মুখোমুখি। কোনো কথা নেই। পরস্পর কেমন যেন চুপ মেরে আছি।

কেন ? ঠিক বুঝতে পারছি না। আছি এটা অনুভব করতে পারছি। একটা নীরবতা গ্রাস করে নিচ্ছে আমকে।জানি না অন্যজন কেমন আছে। কারণ আমরা কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারি না। শত চেষ্টা শর্তেও।কোনো শব্দও শুনতে পাই না। অনুভব করতে পারি আছি। মন উজার হওয়া কথাগুলো ভাসতে থাকে চোখের সামনে। পাহাড় ধোয়া জলও ছোঁয়া যায়। অথচ শব্দগুলো কেমন ভেসে যাচ্ছে সাবলীল ভাবে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাকে দেখতে পাচ্ছি। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কখনও আনমনা ভাবে পাশ পাশ ফিরে অন্যদিকে চেয়ে আছে। সে যেভাবে দেখাবে আমাকে তাই দেখতে হবে। আমার মতো করে আমি তাকে দেখতে পাবো না। তাকে হাসবার কথা জানাতে পারি। সে হেসে কুটিকুটি হতে পারে। আমিও হাসতে পারি।ভীষণ জোরে গলা ফাটিয়ে। পাশের বাড়ির প্রতিবেশি ফোন করতে পারেন। সুস্থ আছি কিনা জানতে আগ্রহী হতে পারেন। নীলা বৌদির মিষ্টি রিনিঝিনি গলা কানির কাছে বেজে উঠতে পারে। কি ব‌্যাপার এত এত রাতে! গলা আরো আরো মোলায়াম হপে পারে। গাঢ় স্বর পাশের ফ্ল‌্যাট থেকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমি ভাসছি মেঘের ভেলায়। সে কোন নদীর ধারে। কিংবা নির্জন রাস্তার ধারে উঁচু দক্ষিণ খোলা

কোণে। হুস করে দ্রুতগামী কোনো গাড়ি পার হয়। কোনো অজানা পাখি ডেকে যায় উড়ে।

মারুফার বিস্ময়ে হাসে। কপালের টিপটা আলগা হয়নি এখনো । কপালের চুলগুলো দুষ্টু বাতাসে এলোমেলো করে যায়। বাঁ হাত কপাল ছুঁয়ে ঠিক করে নিতে চায়। শব্দকে বহ্ম বলে। আমি ঠিক জানি না। ছোটো খাটো শব্দগুলো ফুল হয়ে ভাসে। হাসনুহানা, গোলাপ, কামিনী', জুঁই মারুফার ছুঁয়ে আছে। কত শত মালা গাঁথা হয়।প্রতিদিন। জীবনযাপনের টুং টাং ভেঙে পড়া বোধ রুচি জমা হয় রিসাইকেলবিনে। ঘেঁটে দেখার সময় বড় কম। জমতে থাকা ঝুড়িটা একদিন কেউ না কেউ সাফ করে দেয়। ফিরে দেখে ক’জন! আমার ফুলের সুবাস নিলে না তুমি। আসলে তুমি নিতে পারো কিনা সেটাই জানা হয়ে ওঠে না। তোমার ফুলের সুবাসও আমি নিতে পারিনি। কোনো না কোনো কারণে গড়ে ওঠে সম্পর্ক। হাত ধরে হাঁটি। আইসক্রিমে গাল ভরিয়ে পেসট্রিটে কামড়। কিছু একটা করব বলে টলটলে পায়ে ফিলটারেই ধরায় আগুন।

শূন্যটা গ্রাস করে আছে। আমাদের একত্র জীবনযাপনের ফাঁক গলে আমরাই কখন হয়ে উঠি অন্য মানুষ।আমাদের ছোটোকাল, উনিশ-কুড়ি জানা হয় না। জানতে চাই না বা জানাই না।

গোপনতা জমে থাকে নিজস্ব গোপন কুঠুরিতে। কালাধারে। কিছুটা অচেনাই থেকে যাই। বের হলে কখনও বিপন্নতা। সেখানেই মুখোমুখি। অন্য কোনো মুখ আর এক মুখের কাছে আসে। জানি না। অচেনা চেনা হয় দূর থেকেই। না জানা বাড়তে থাকে। তখনই....

-ভালো আছো?

-তুমি?

-ভালো। তোমার কবিতার অনুষ্ঠানটা কেমন হলো।

-বেশ ভালো হয়েছে। অনেকেই বেশ খুশি । কেউ কেউ এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেল।

-তাহলে খুব ভালো হয়েছে বলো। তুমিতো খুব চিন্তায় ছিলে। বলে ছিলাম না মনে জোর আনো। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি এখান থেকে তোমাকে আর কতটা সাহায্য করতে পারি। কিছু বইয়ের খবর দিতে পারি। কিন্তু জোগাড় তোমাকেই করতে হয়েছে। আমি এক প্রান্তে আর তুমি কোথায়। অন্য দেশে। তবু আমরা কত কাছে। মনে হয় তোমার নিঃশ্বাসের শব্দও আমি পাই। কোন ফুলের অভিনন্দন নেবে তুমি। তোমার ঘরের রঙ জানি না। কোন ফুলে সাজানো ঘর। তোমার পরিবারপরিজন কিছুই জানি না আমি। তুমিও জানো না। কখনো কারো ছবি দেখোছো। যেমন আমিও। এখানেই মুখোমুখি চেনা। বসে থাকা। তির তির করে বয়ে যায় শব্দ। একটা ক‌্যানভাস ক্রমশ রঙিন থেকে রঙিন হয়।

তুলির টানে গড়েওঠে অবয়ব। কুলকুলে নদী এক পার ভেঙে গড়েতোলে নিজস্ব ভূমি। সেই

অন্যভূবনে দুজন মুখোমুখি ছাড়া নেই অন্য কোনো মানুষ। পাখা মেলে অন্য জগৎ। নিজস্ব গোপনতা ভাঙে।মনের শূন্যতা ক‌্যানভাস ভরায় রঙের গভীরতায়। রাত গভীর হয় মুখোমুখি তুলি হাতে আমরা দুজন।তোমার পিছনে নেই অন্য চোখ। আমারও। দেশের গণ্ডী ছেড়ে অন্যখানে আর এক মানুষ। প্রজাপতি মেলে রঙ। চেনা জন দেখে না মেলে চোখ।

হালকা নীল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকো ব‌্যালকনিতে। আমি তোমায় ঠিক দেখে নেব। তোমার ছড়ানো চুলের জুঁই গন্ধ ঠিক পেয়ে গেছি আমি। মারুফার চাঁদের আলো তোমাকে ছুঁয়ে যাবে।

আমার আগে কেউ তোমাকে ছুঁয়ে যাক চাই না আমি।


এবার পি সি-র আলো নিভে যাক। কাল আবার। এই পৃথিবীটা আমাদেরই থাক।

ভ্রমণ - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য

পুরীর রথ
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য



বাঙালির প্রিয় জায়গা হলো পুরী । ওডিশার ( সরকারী ভাবে এখন এই নাম ) বঙ্গপোসাগরের ধারে এই শহরটিতে গেলে একসঙ্গে রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই হয় ।

যাওয়াটাও খুব একটা হ্যাপার নয় । হাওড়ায় গিয়ে প্রায় গোটা পাঁচ – ছয়েক ট্রেনের মধ্যে একটাতে চেপে পড়লেই হলো ।

হোটেলের খুব একটা সমস্যা নেই । তবে, রথের সময় কিন্তু ভারী মুশকিল । আগে থেকে ঠিক না করে গেলে মুশকিল ।

এবারে এই রথযাত্রা সম্বন্ধে কিছু জেনে নেই আমরা ।

রথযাত্রা আর্যজাতির একটি প্রাচীন ধর্মোৎসব। কিন্তু এখন রথযাত্রা বললে সাধারণত জগন্নাথদেবের রথযাত্রাকেই বোঝায়। কিন্তু একসময় ভারতবর্ষে সৌর, শক্তি, শৈব, বৈষ্ণব, জৈন, বৌদ্ধ সব ধর্ম-সম্প্র্রদায়ের মধ্যে স্ব স্ব উপাস্যদেবের উৎসববিশেষে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হতো।


প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ এবং পদ্মপুরাণে রথযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার রথ কেমন হবে, সে সম্পর্কে বলা আছে। বিষ্ণুধর্মোত্তরে একই রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা—এই তিনটি মূর্তি স্থাপন নির্দেশ থাকলেও পুরুষোত্তম মাহাতো ও নীলাদ্রি মহোদয়ের পদ্ধতি অনুসারে পুরীধামে আজ পর্যন্ততিনজনের জন্য তিনটি বৃহৎ রথ প্রস্তুত হয়ে থাকে।
রথযাত্রার প্রচলন ঠিক কোন সময়ে হয়, তা এখনো স্থিরনিশ্চিত হয়নি। কারও কারও মতে, বুদ্ধদেবের জন্মোৎসব উপলক্ষে বৌদ্ধরা যে রথযাত্রা উৎসব করত, তা থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রার উৎপত্তি। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন, ভারতে প্রতিমাপূজা প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে রথযাত্রার উৎসব প্রচলিত হয়।
উৎকলখণ্ড এবং দেউলতোলা নামক ওডিশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, সত্যযুগে অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্র নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাজা ইন্দ্র পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন।

বৌদ্ধযুগেও জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অনুরূপ রথে বুদ্ধদেবের মূর্তি স্থাপন করে রথযাত্রার প্রচলন ছিল। বিখ্যাত চীনা পর্যটক ফা হিয়ান খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকে তৎকালীন মধ্য এশিয়ার খোটানে স্থানে, যে বুদ্ধ রথযাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন, তা অনেকাংশে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ত্রিশ ফুট উঁচু চার চাকার একটি রথকে বিভিন্ন রত্ন, অলংকার ও বস্ত্রে সুন্দরভাবে সাজানো হতো। রথটির চারপাশে থাকত নানা দেবদেবীর মূর্তি। মাঝখানে স্থাপন করা হতো বুদ্ধদেবের মূর্তি। এরপর সে দেশের রাজা তাঁর মুকুট খুলে রেখে খালি পায়ে রথের সামনে এসে নতমস্তকে বুদ্ধদেবের উদ্দেশে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর মহাসমারোহে রথযাত্রা শুরু হতো। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় আজও আমরা দেখে থাকি যে প্রতিবছর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা। রাজত্ব না থাকলেও বংশপরম্পরাক্রমে পুরীর রাজপরিবারের নিয়মানুযায়ী যিনি রাজা উপাধিপ্রাপ্ত হন, তিনি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পরপর তিনটি রথের সামনে এসে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান ও সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথের সম্মুখভাগ ঝাঁট দেওয়ার পরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে। শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা।


তবে সূর্য-রথই যে সব রথের প্রথম, তা পুরাণে বলা আছে।
পূর্বে ভারতীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে কার্তিক মাসে শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রার অনুষ্ঠান হতো। বৌদ্ধ প্রভাবকালে তা বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ভবকালে উৎকলবাসীর মনোরঞ্জনের জন্য সেই সময়েই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা প্রচলিত হলো। এই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ক্রমে সর্বত্র প্রচলিত হলে শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রার বিষয় অনেকেই ভুলে গেল। তবে হিমালয়ের কোনো কোনো স্থানে দেবীর রথযাত্রার কথা এখনো শোনা যায়। নেপালে কি বৌদ্ধ, কি শৈব সর্বসাধারণের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার রথযাত্রা প্রচলিত আছে।
পুরীর সমুদ্রকেও ছাপিয়ে ওঠে রথের মেলার জনসমুদ্র।
পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে যে আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা অনুষ্ঠান শুরু করে শুক্লা একাদশীর দিন পূর্ণযাত্রা বা উল্টোরথ অনুষ্ঠিত হবার কথা। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রাও প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যদিও আষাঢ় মাসের পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতেই রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হওয়ার নিয়ম। কিন্তু প্রতি বছর তো আর পুষ্যানক্ষত্রের সঙ্গে আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথির যোগ হয় না, তাই কেবল ওই শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতেই রথযাত্রা শুরু হয়ে থাকে। তবে কখনও এই তিথির সঙ্গে পুষ্যানক্ষত্রের যোগ হলে সেটি হয় একটি বিশেষ যোগ-সম্পন্ন রথযাত্রা ।

পুরীর রথযাত্রা উৎসব হচ্ছে বড় ভাই বলরাম বা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন যাত্রার স্মারক। তিন জনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় হল এই রথ তিনটি। প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড় ভাই বলভদ্রের রথ। তারপর সুভদ্রা পরে জগন্নাথ ।

বলভদ্রের রথের নাম:- তালধ্বজ্ ।

সুভদ্রার রথের নাম:- দেবদলন।

জগন্নাথের রথের নাম:- নন্দিঘোষ।



রথগুলির বর্ণনা:-



তালধ্বজ্ (বলভদ্র/বলরাম) -

উচ্চতা- ১৩.২ মিটার।

কাঠের টুকরো-৭৬৩ টি।

ধ্বজার/পতাকার নাম- উন্মনী।

রথের কাপড়ের রং- লাল সবুজ।

চাকা-১৬ টি।



দেবদলন (সুভদ্রা) -

উচ্চতা-১২.৯ মিটার।

কাঠের টুকরো-৫৯৩টি।

ধ্বজার/পতাকার নাম- নাদম্বিক।

রথের কাপড়ের রং- লাল কালো।

চাকা-১৪ টি।



নন্দিঘোষ (জগন্নাথ) -

উচ্চতা- ১৩.৫ মিটার।

কাঠের টুকরো- ৮৩২ টি।

ধ্বজার/পতাকার নাম- ত্রৈলোক্যমোহিনী।

রথের কাপড়ের রং- লাল হলুদ।

চাকা-১৮ টি।

রথ তিনটি সমুদ্রোপকূলবর্তী জগন্নাথ মন্দির থেকে প্রায় দু’মাইল দূরে গুণ্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। সেখানে সাত দিন থাকার পর আবার উল্টোরথ অর্থাৎ জগন্নাথ মন্দিরে ফিরে আসা। এখন তিনটি রথ ব্যবহৃত হলেও আজ থেকে সাতশো বছর আগে রথযাত্রার যাত্রাপথ দুটিভাগে বিভক্ত ছিল। আর সেই দুটি ভাগে তিনটি-তিনটি করে মোট ছটি রথ ব্যবহৃত হত। কেননা সে সময় জগন্নাথ মন্দির থেকে গুণ্ডিচা আসার পথটির মাঝখান দিয়ে বয়ে যেত এক প্রশস্ত নালা। নাম ছিল বলাগুণ্ডি নালা। তাই জগন্নাথ মন্দির থেকে তিনটি রথ বলাগুণ্ডি নালার পার পর্যন্ত এলে পরে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তি রথ থেকে নামিয়ে নালা পার করে অপর পারে অপেক্ষমাণ অন্য তিনটি রথে বসিয়ে ফের যাত্রা শুরু হত। ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে রাজা কেশরী নরসিংহ পুরীর রাজ্যভার গ্রহণের পর তাঁর রাজত্বকালের কোনও এক সময়ে এই বলাগুণ্ডি নালা বুজিয়ে দেন। সেই থেকে পুরীর রথযাত্রায় তিনটি রথ।





এবারে আসা যাক, নব কলেবর প্রসঙ্গে। যে নিম গাছগুলি থেকে বিগ্রহগুলির নবকলেবর হবে; সেগুলির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য থাকবে। ১) নিমগছের রং ঘন কালো হবে।

২) এই গাছের কাণ্ডের ব্যাস কম করে ১২ ফুট হবে।

৩) এক একটি গাছের ৪ টি প্রধান শাখা থাকবে।

৪) গাছগুলি কোন নদী বা পুকুরের পাশে থাকবে। গাছগুলিকে ৩টি রাস্তার সংযোগস্থলে খুঁজে পেতে হবে।

৫) গাছগুলি বরুণগাছ ও বেলগাছ দ্বারা পরিবৃত থাকবে।

৬) গাছগুলি ৩টি পাহাড় দ্বারা পরিবৃত থাকবে।

৭) নিমগাছের কাছেই কোন আশ্রম থাকবে।

৮) একটি শ্মশান ভূমিও থাকবে।

৯) ভগবান বিষ্ণুর ৪টি পবিত্র চিহ্ন – শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্মের ছাপ থাকবে গাছের কাণ্ডে।

১০) নিমগাছের কাছেই উইপোকার ঢিবি থাকবে।

১১) পাখীর কোন বাসা থাকবে না গাছে।

১২) নিমগাছের ওপর কোনদিন বাজ পড়া চলবে না। ঝড়ে, নিমগাছের কোন শাখা প্রশাখা ভাঙ্গা চলবে না।

১৩) নিমগাছের নীচে গোখরো সাপের বাসা থাকতে হবে।

১৪) নিমগাছের নীচে কোন ঝোপঝাড় থাকা চলবে না।

এই ১৪ টি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কম করে ৫ টি বৈশিষ্ট্য থাকলেই নবকলেবরের জন্য সেই নিমগাছ নির্বাচন করা হবে।





সরকারী রেকর্ডে ১৭৩৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে নবকলেবরের নথীভূক্তকরণ আছে। তারপর ১৮০৯,১৮২৮,১৮৫৫,১৮৭৪,১৮৯৩,১৯১২,১৯৩১,১৯৫০,১৯৬৯,১৯৭৭,১৯৯৬ পর্যন্ত আছে।

উৎস:- আমার পুরীতে কর্মরত অবস্থায় পুরীর পাণ্ডা বন্ধুদ্বয়; শ্রী বনবিহারী পতি ও শ্রীবিপিন পতি, পুরীর সরকারী গেজেট ও শারদীয় “বর্তমানে” প্রকাশিত শ্রী সুমন গুপ্তের প্রবন্ধ ও মণীশ সিংহ রায় আনন্দবাজার পত্রিকা।

তাহলে পরের বার চলুন, বেড়িয়ে পড়া যাক পুরীর উদ্দেশ্যে ।

প্রবন্ধ - নারায়ণচন্দ্র দাস

ধর্ম্ম শব্দের অর্থ কী?
কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী ধর্ম্ম শব্দের অর্থ কী? (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুসরণ করে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী যে বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ সংকলন করেছেন, তার ১ম খণ্ডে ধর্ম্ম শব্দের যেরূপ অর্থ প্রদত্ত হয়েছে, এখানে সেটি উপস্থাপন করা হল ।) ১) ব্যুৎপত্তি নির্ণয় – ধৃ + ম (মন্) – কর্তৃবাচ্যে । (বঙ্গীয় শব্দকোষ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় – সংক্ষেপে ‘ব.শ.’ ।) ২) ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ – ধর্ মিতি মিত যাহাতে । (বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী – সংক্ষেপে‘ব.শব্দা.’) । শরীরসাধন যে কর্ম্মের অপেক্ষা করে । (অমরকোষ) । লোকধারণ করে যে। (ব.শ.) । ৩) অভিধানাদিতে প্রদত্ত প্রতীকী অর্থ – বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুসারে : শ্রেয়ঃ, শুভ অদৃষ্ট, পুণ্য, চতুর্ব্বর্গের একতম, আচার, শাস্ত্রদৃষ্টকার্য্যমাত্র, সম্প্রদায়বিশেষের শাস্ত্রবিধি, ন্যায়, নীতি, স্বভাব, অসাধারণ গুণ, উপমা, অভিধেয় বস্তু, অহিংসা, যজ্ঞাদি, উপনিষৎ, ঈশ্বরে অনুরাগ, আত্মা, সোমপ, যম, অর্হদবিশেষ, যুধিষ্ঠির, ব্রহ্মার দক্ষিণস্তনজাত দেবতাবিশেষ, জীবাত্মা, সৎসঙ্গ, ধনুঃ, তপঃশৌচাদিপাদচতুষ্টয়যুক্ত ধর্ম্মের বৃষরূপ, লগ্ন হইতে নবম স্থান, গ্রাম্য দেবতা ধর্ম্মঠাকুর । (পাঠক, অন্যান্য অভিধান ও শব্দকোষ দেখে নিতে পারেন) । … ৪) শব্দটি religion অর্থে ও ‘ধর্ম’ বানানে প্রচলিত । ৫) কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ : … … … কৃষিকাজ করে শস্য উৎপাদন করা কৃষকের ধর্ম্ম । ধরবার যত প্রক্রিয়া আছে, তার ভিতর থেকে কৃষক কেবল শস্য-উৎপাদন প্রক্রিয়াকেই বাস্তবায়িত করার কথা ভাবেন । আর, তা যখন তিনি বাস্তবায়িত করে আত্মীয়-পরিজনের খাদ্য রূপে উপস্থিত করে দেন, তখনই তাঁর ধর্ম্ম রক্ষিত হল । এক্ষেত্রে ‘বিশেষ প্রক্রিয়া’ বা ধৃ-মিতি হল ‘শস্য-উৎপাদন প্রক্রিয়া’; আর তা যে ‘বিশেষ এলাকা’য় মিত হল, সেই এলাকা কৃষকের ক্ষেত্র ও আত্মীয়-পরিজন । এইভাবে কৃষকের এই সমগ্র আচরণটির দ্বারা তাঁর ধৃ-মিতি মিত হল বলে একে কৃষকের ধর্ম্ম বলে । তার মানে, ‘ধর্-এর মিতি মিত যাহাতে, যে স্থানে, যে কর্ম্মে, যে আচরণে …’, সে সবকে ধর্ম্ম বলে । সেই হিসেবে সমাজকে (তদ্রূপ সমাজরূপে) ধরে রাখে তার যে বিশেষ প্রকারের ক্রিয়াকলাপ, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, তার সুনির্দিষ্ট এলাকাকে সমাজের ধর্ম্ম বলে । মানুষকে (তদ্রূপ মানুষরূপে) ধরে রাখে তার যে বিশেষ প্রকারের ক্রিয়াকলাপ আচারাদি, তার সুনির্দিষ্ট এলাকাকে মানুষের ধর্ম্ম বলে । বস্তুকে (তদ্বস্তুরূপে) ধরে রাখে তার যে বিশেষ প্রকারের ক্রিয়াকলাপ, তার সুনির্দিষ্ট এলাকাকে বস্তুর ধর্ম্ম বলে । এই যে ধর্ম্ম, এর দুটি দিক রয়েছে – অন্তর্দেশীয় ও বহির্দেশীয়, অর্থাৎ, ঘরের ধর্ম্ম এবং বাইরের ধর্ম্ম । বস্তু, মানুষ, সমাজ …প্রত্যেকেরই আভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ স্বতঃই প্রচলিত থাকে, এবং সেই ক্ৰিয়াকলাপই তার অস্তিত্বের পরিসীমার মধ্যে তাকে ধরে রাখে; তাই সেই ক্রিয়াকলাপই তার ধর্ম্ম । এই ধর্ম্ম পালন না করলে অস্তিত্বের (বা সেই সত্তার) শরীরটাই বিলুপ্ত হয় । যে কারণে অমরকোষ বলেছেন, ‘(সত্তার) শরীরসাধন যে কর্ম্মের অপেক্ষা করে, তাকেই (তত্তদ সত্তার) শরীরের ধর্ম্ম বলে’ । অণুর ভিতরে পরমাণুদের আচরিত কর্ম্মই অণুটির ধর্ম্ম । সেই ধর্ম্ম পালন না করলে অণুর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় । সমাজের ভিতরে তার সদস্যস্বরূপ মানুষদের আচরিত কর্ম্মই সেই সমাজের ধর্ম্ম । সেই ধর্ম্ম পালন না করলে সেই সমাজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় । প্রতিটি অস্তিত্বের বা সত্তার ভিতরে এইরূপ নিজ নিজ ধর্ম্ম থাকে, যার উপর সত্তাটির টিকে থাকা নির্ভর করে । তার মানে, কর্ম্ম যেমন আত্ম-ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার কার্য্যাবলীকে বোঝায়, ধর্ম্ম তেমনি আত্ম-অস্তিত্বকে ধরে রাখার জন্য করণীয় কার্য্যাবলীকে বোঝায়। আর যেহেতু কর্ম্মই সেই কার্য্যাবলী, তাই (সত্তার) কর্ম্মই (তার) ধর্ম্ম পদবাচ্য । অতএব এ জগতে প্রতিটি অস্তিত্বই তার নিজধর্ম্ম পালন করে তবেই টিকে থাকে এবং সেই সুবাদে এ জগতে ধর্ম্মহীন কোনো সত্তাই নেই; সকলে আপন আপন ধর্ম্মে যথার্থেই ধর্ম্ম-পরায়ণ, ধার্ম্মিক । ধূলিকণা থেকে শুরু করে মহাবিশ্ব পর্যন্ত প্রতিটি সত্তাই ধর্ম্ম-পরায়ণ । অস্তিত্ব মাত্রেই, তা সে মাটির ঢেলাই হোক আর কুকুর বেড়াল ডাক্তার মাস্টার … যেই হোক, প্রত্যেকেই যে-যার নিজের অস্তিত্বের ধর্ম্ম অবশ্যই মানেন, অন্যথায় তাঁর অস্তিত্বের বিপর্যয়, মৃত্যু বা বিলুপ্তি অনিবার্য । অবশ্য অস্তিত্বসমূহের ইত্যাকার ধর্ম্ম স্বরূপে প্রকাশিত না হয়ে কখনো কখনো ভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়, বিশেষত যখন অন্য কোনো সত্তার সঙ্গে এই ধর্ম্মপরায়ণ সত্তাসমূহের, অর্থাৎ এই বস্তু-ব্যক্তি-সমাজের সম্বন্ধ ও পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে । সত্তার এই প্রতিক্রিয়া-জনিত ধর্ম্ম-স্বরূপটিকে প্রায়শই ভিন্ন বলে মনে হয় । কিন্তু গভীরে অভিনিবেশ করলে বোঝা যায় যে, সেই প্রতিক্রিয়া-জনিত স্বরূপটি আদতে তাদের আভ্যন্তরীণ ধর্ম্ম থেকেই জন্ম লাভ করেছে । এটি কোনো নতুন ধর্ম্ম নয়; সম্বন্ধিত সত্তা দুটির আভ্যন্তরীণ ধর্ম্মের আত্মীয়তা ও শত্রুতার মিলিত ও নিঃসারিত ফল । … আজকাল একে বস্তুর ‘প্রতিক্রিয়া’ বলা হয়। পাশ্চাত্যে বস্তুর এই প্রতিক্রিয়াকেই বস্তুর ধর্ম্ম বা property বলা হয়ে থাকে । কিন্তু ধর্ম্ম শব্দের বানানে দুটো ম কেন? হ্যাঁ, ধর্ ক্রিয়ার সঙ্গে মন্-এর বা ‘মিত’-এর যোগসাধন করতে গেলে মাঝে একটি ম-এর আগম ঘটে । কর্ম্ম, চর্ম্ম, ধর্ম্ম … প্রভৃতি সকল সমজাতীয় শব্দের ক্ষেত্রেই এটি ঘটে । আর, সেটি কেবল জিহ্বা-যন্ত্রের সুবিধার জন্য ঘটে এমন নয়, বাস্তবেও একটি ক্রিয়ার সঙ্গে আর একটি ক্রিয়ার যোগসাধনের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই পূর্ব্বতন ক্রিয়াটিকে একটু কাটছাঁট করে নিতে হয়, নইলে ক্রিয়াদুটি হাত ধরাধরি করতে পারে না, আগুপিছু হয়ে যায় । এই পরিস্থিতি তৈরি হয় পূর্ব্বতন ক্রিয়াটি (এখানে ধৃ বা ধর্) যদি আবর্ত্তন (ঋ) মূলক হয় । একটি মানুষ যদি বনবন করে ঘুরতে থাকে, তার হাত ধরা মুশকিল । তাই, ধৃ-কে ধর্ করে নিলেই চলে না, তাকে ধর্ ম্-এ পরিণত করে নিতে হয় । এবার তার সঙ্গে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে যেতে পারে ম । তখন ‘ধর্ ক্রিয়ার মিতি (ম্) মিত (ম)’ হয়ে ধর্ম্ম-তে পরিণত হয়ে যায় । আর তার ফলে ‘ধরবার বিশেষ প্রক্রিয়ার বিশেষ এলাকা’ অর্থটি ধর্ম্ম শব্দের মধ্যে ধরা হয়ে যায় । কিন্তু তা না করে শব্দটিকে ধর্ম লিখে ফেললে, তা মানে হয়ে যায় – ‘ধর মিত যাহাতে’, অর্থাৎ, ‘ধরবার বিশেষ এলাকা’ । একই ঘটনা ঘটে কর্ম্মাদি শব্দের বেলায় । কর্ম্ম ও ধর্ম্ম শব্দের নিহিত অর্থের ব্যাখ্যায় আমরা দেখেছি, ‘করা’-কে কমিয়ে শুধুমাত্র টেবিল-করার জ্ঞানে পৃথক করে না নিলে টেবিল বানানোর কর্ম্মটি করা যায় না; ‘ধরা’কে অর্থাৎ শস্যাদি উৎপাদন ও বণ্টনে আপন অস্তিত্ব ধারণ করাকে পৃথক করে না নিলে কৃষকের ধর্ম্ম পালন করা যায় না । আপনি যদি আপনার সকল কারুকাজের জ্ঞান নিয়ে টেবিল বানাতে যান, টেবিল বানানো যাবে না; আর তাছাড়া সেরকম হওয়াও অসম্ভব । … তাই ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি মান্য করতে হলে আপনাকে কর্ম্ম, ধর্ম্ম, চর্ম্ম, ঘর্ম্ম, নর্ম্ম … ইত্যাদি বানানে শব্দগুলি লিখতে পড়তে হবে । তবে প্রতীকী শব্দবিধিতে কর্ম, ধর্ম … ইত্যাদি চলতে পারে । কারণ, তখন কর্ম, ধর্ম শব্দের অর্থ আপনাকে শব্দদুটির ভিতর থেকে বের করতে হচ্ছে না; তখন কর্ম মানে work, ধর্ম মানে religion; শব্দের বানানের সঙ্গে যে অর্থের কোনো সম্বন্ধই নেই । উপরে ধর্ম্ম শব্দের ৩-এ প্রদত্ত অর্থগুলি যাদের চিহ্ণিত করে, দেখা যায়, তারা কোনো না কোনোভাবে ধর্ম্ম শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থের কোনো না কোনো স্থির প্রতীকী হয়ে যাওয়া রূপ মাত্র । যেমন (ধর্ম্ম শব্দের) ‘শাস্ত্রদৃষ্টকার্য্যমাত্র’ অর্থটির কথাই ধরা যাক । শাস্ত্রাদিতে বা গ্রন্থাদিতে যে সকল কাজের কথা দেখতে পাওয়া যায়, সেসব প্রধানত মানুষের নিত্য ধর্ম্ম ও নৈমিত্তিক ধর্ম্মের কথাই । প্রতিদিন যে খাদ্যাদি গ্রহণ, মলমূত্রাদি বর্জন … ইত্যাদি করতে হয়, এসব হল নিত্য ধর্ম্ম । আবার, কাউকে কেউ খুন করল, সেটা দেখে ফেললে খুনীর নাম বলে দেওয়ার জন্য মনুষ্যত্ব যে ছটফট করে, এটাও মানুষের নিত্য ধর্ম্ম । কারও কাছে বেতন নিয়ে তার কাজ করে দেওয়া হল নৈমিত্তিক ধর্ম্ম । সুতরাং, ধর্ম্ম শব্দের প্রতীকী অর্থ রূপে ‘শাস্ত্রদৃষ্টকার্য্যমাত্র’কে উল্লেখ করাই যায়, আর বঙ্গীয় শব্দকোষ সেটাই করেছেন । বলতে কী, বঙ্গীয় শব্দকোষ লিখিত সমস্ত প্রতীকী অর্থগুলিই কমবেশি এই রকম । … সবশেষে ধর্ম্ম শব্দের ব্যবহার বিষয়ে কিছু তথ্য জানা জরুরি । প্রথমত, আধুনিক শিক্ষিত বাংলাভাষী ধর্ম্ম শব্দটিকে ফেলে দিয়ে religion-বাচক ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন । কিন্তু ধর্ম্ম শব্দটি এত ব্যাপক অর্থধারী ছিল যে, বাংলাভাষীর উত্তরাধিকারে মানুষের জীবনের ও সমাজের বিশাল অংশ জুড়ে সে বিদ্যমান ছিল । ফলে, ইংরেজিবাদী বাংলাভাষীর একগুঁয়ে চেষ্টা সত্ত্বেও ধর্ম্মশব্দটি আদৌ পরিত্যক্ত হয়নি; সাধারণ বাংলাভাষীর মুখে তার ব্যবহার আজও ব্যাপকভাবে টিকে রয়েছে । তাছাড়া আজকের বাংলাভাষীর জীবনের প্রাত্যহিক প্রয়োজনই শব্দটির নবজাগরণ দাবি করছে বিপুলভাবে । একজন মজুর কিংবা কেরানি যথাসময়ে কাজে যান, নির্দেশ মতো কাজ করেন, কর্ম্মান্তে বেতন নেন – ক্রিয়াভিত্তিক শব্দবিধি অনুসারে এরকম মানুষ যথার্থে ধর্ম্মপরায়ন, ধার্ম্মিক । একই কারণে আপন আপন সামাজিক নৈমিত্তিক-ধর্ম্মে বা কর্ম্মে একনিষ্ঠ চাষী, জেলে, ছুতার, কুলি, তাঁতি, শিক্ষক, ডাক্তার, সরকারি কর্ম্মচারী … ইত্যাদি মানুষেরা প্রত্যেকেই ধার্ম্মিক পদবাচ্য । কেননা, তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ ধর্ম্ম পালন করে থাকেন । টিকি-দাড়ি-পৈতা-টুপি পরে অদৃশ্য কোনো শাসকের প্রশংসায় যিনি সময় কাটান, তাকে আর যাই বলা যাক, ক্রিয়াভিত্তিক শব্দবিধি অনুসারে ধার্ম্মিক বলা যায় না । একইভাবে যাঁরা শেয়ার বাজারে টাকা খাটায়, নিজে কোনো পণ্য বা পরিসেবা উৎপাদন করে না, কেবল অধর্ম্ম দ্বারা অর্থোপার্জন করে, কিংবা যারা ধর্ম্মবৈতংসিক, তাদেরকেও ধার্ম্মিক বলা যায় না । [ ধর্ম্ম বিষয়ের এই অর্থ আমাদের জানায়, জগতের প্রতিটি সত্তার নিজ নিজ ধর্ম্ম আছে । মানুষের সেই আদি অকৃত্রিম স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক ধর্ম্মকে তার সনাতন ধর্ম্ম বলা হয়, অন্যত্র বলেছেন লেখকদ্বয় । তৃষ্ণার্তকে জল দেওয়া, কথা দিয়ে কথা রাখা, মূল্য নিলে তার প্রতিদান দেওয়া, বিপন্নকে রক্ষা করা, শিশু ও বৃদ্ধকে সহায়তা করা … এসবই মানুষের সনাতন ধর্ম্ম । সেই ধর্ম্ম অধঃপতিত হয়ে গ্লানিগ্রস্ত (যদা যদা হি ধর্ম্মস্য …) হলে ধর্ম্মস্রষ্টার জন্ম হয় । তাঁরা মানুষের সনাতন ধর্ম্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় নতুন ধর্ম্মচক্র প্রবর্ত্তন করেন । কিন্তু জগতের নিয়মে সেই নবধর্ম্ম কিছুকাল পরে পুনরায় গ্লানিগ্রস্ত হতে শুরু করে । মানুষের ধর্ম্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ক্রমে মন্দির মসজিদ গির্জা গুরুদ্বারার ... প্রাতিষ্ঠানিক ও মৌলবাদী ধর্ম্মে পরিণত হয়ে যায় । ধর্ম্ম-এর মৌলবাদী, বিকৃত, হিংস্র, অন্ধ ও আধুনিক রূপটির বিরোধীতা করতে গিয়ে সার্বিকভাবে ধর্ম্ম-এর আমূল বিরোধীতা করাটা - ইংরেজিতে যাকে বলে throwing the baby out with the bathwater সেই কাজ করার সমতুল । বিপদ এখানেই ।

কবিতা - কচি রেজা

সাদা ইউনিফর্ম
কচি রেজা



(১)
সাদা য়ুনিফর্ম হয়ে তুমি আমার কাছে আসো
কিছু উৎপন্ন ডিম রেখেছি দেখো হারমনিয়ামের রীডে

(২)
পরীক্ষা করো আমাকে চোখদুটিতে কেন উভলিঙ্গ পোকা
পাগলের জনন কোষ বলে আমি ও কি নিরপেক্ষ মৃগী রোগী

(৩)
একসাথে নেচে জোড়া লেগে গেছে বুকের কবুতর
তুমি চলে গেলে সাদা কাগজেও আরেকটি তুমি

(৪)
কান্না দেখে চশমাও ভিজেছিল খুব
বাইবেল না কি সংক্রামক প্রাচ্যদেশী এই অহংকার
তোমাকে নয় নিজেকে উপভোগ করার জন্যই
বিকিনি খুলতে দিয়েছি সুস্বাদু হরিণকে

(৫)
কাঁটাচামচে বৈশিষ্ট্য কেটে খাচ্ছে ঘনিষ্ঠতা
পাতলা কাচের শব্দে জোড়াঠোঁট কেটে যায়

(৬)
তোমাকে চুম্বন করে যে জীবাণু করি পান
তুমি তার রাখো নি সন্ধান

(৭)
আমিও মেটালকয়েন খুঁজে বেড়াচ্ছি সীবিচে
নিঃসঙ্গতা চায় না কেউ তার সমকক্ষ হোক
ডিটেকটর সংকেত দিলে উঠে আসে
পেশীহীন শামুকের সঙ্গমদৃশ্য

(৮)
কোথাও গেলে দেহ রেখে যাই
কেউ ষ্ট্রাকচারের প্রশংসা করলে
দু'জন ইঞ্জিনীয়ারের নাম বলি

(৯)
প্রেম দিয়ে কি আরেকটি সংসদ ভবন গড়বেন, লুই কান
আমার লবন নিন

কবিতা - অনুপ দত্ত

সেই লোকটা
অনুপ দত্ত



সেই লোকটা৷ কত দিন বসে আছে ফুটপাতে
যেন পৃথিবী অভিমান নিয়ে এক কোনে চেয়ে আছে
নিজেকে হরফ করে বিছানোর ছায়া কবে ঢাকা পড়েছিলো...
এই পৃথিবীর মুখে৷হাস্যরসে ভরপুর নিবাসী শাস্ত্রের সংলাপে৷

যেন আঘাতে, ঐশ্বরিক প্রেমের আঘাতে গাছের আড়ালে
গাছপালা ভেঙ্গে ফোকরে ফোকরে জেগে ওঠে ভূষন্দির মাঠ৷

যেন কতদিন,ঘুমায়নি যৌবন৷
চেয়ে চেয়ে কেটে গাছে জীবনের উলঙ্গ করা রাত৷

যেন শরীর,ভাঙ্গা আয়নায় জড়িয়ে শিহিরণ ধরে
রেখেছিল কাঁপা কাঁপা এক হাত৷
যেন ফেরিওয়ালা,কতদিন ফেরি করে নি কল্পবিদ্যা খেলা
সাজায়নি রং মাখা প্রেমের আকুলি বিতান৷

পথের ও পাশে ছেঁড়া ছেঁড়া প্রেমপত্র
উড়ে এসে জোড়েনি এপাশের ফুটপাথে
সেই মানুষের ছেঁড়া ছেঁড়া হৃদয়ের ঘরে
ছেঁড়া শাড়ী ছেঁড়া হৃদয় জোড়েনি কোনদিন৷

যেন টোপ ফেলা, অলক্ষে গাঁথা হয়নি ফল৷
ও ফুটপাতে বসে থাকা ভাঙ্গা কৃষ্ণকলি ছেঁড়া শাড়ী শরীর আধার৷
যেন ময়না পাড়ার মাঠে জাগেনি হরিন চোখে হিল্লোল৷
লাগেনি চৈত্র মাদল৷কোমর ভাঙ্গা লজ্জাবতী গান৷সুদৃশ ফুলেল বান
লাগেনি কোন অযথা সসমীর রোখ
কিন্তু সময় জানিয়ে গেছে সেই কবে থেকে .....
" তা সে যতই কালো হোক...দেখেছি তার কালো হরিন চোখ "

কবিতা - ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

একান্তে
ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত




হঠাৎ স্তব্ধতা নেমে আসে,
হঠাৎ থেমে যায় কথা বলা, নিঃশ্বাস;
ঘাতক হাইওয়েতে পড়ে থাকে অবশেষ।
অনিদ্রা ক্রমশ জমতে থাকে কালো কফির কটুগন্ধ,
রাত কত এখন?
শরীর ক্লান্ত অবশ,
তবু ঘুম নেই।

জীবন কি আসলে কতগুলো মুহুর্ত?
যে মুহুর্ত রণিত হয় ইথারে তরঙ্গে,
যে মুহুর্তের লয় ক্ষয় নেই,
ওই দেখি আত্মজন একে একে যারা ছাড়িয়ে সীমানা
পৌঁছে গেছেন তারাতে,
আকাশের নির্বিবাদি ভোরে।

কিছুই হারায় না,
সুরে বাজে রাত্রিকালীন ভায়োলিন,
একে একে জেগে ওঠে তরঙ্গ ঢেউ,
ভেসে ওঠে মুখগুলো,
হাসি কথা,
ঠিক যেন তারা ঘোরে ফেরে তোমার পাশে-
একান্তে।

কবিতা - আরশাদ উল্লাহ্‌

পাঁচটি হাইকু
আরশাদ উল্লাহ্‌



পূজাপার্বণ,
শুভ্র শেফালী হাতে
ভক্ত পূজারি

শারদ সন্ধ্যা,
দূরে পর্বত 'পরে
উজ্জ্বল তারা

স্নিগ্ধ সুবাস,
তাজা শিউলী হাতে
সুশ্রী তরুণী

পতিত পত্র,
পর্বত পথে হাঁটি
মর্মর ধ্বনি

ঝিঝির ডাক
মাতৃ-বুকে সন্তান,
ঝরিত পত্র

কবিতা - সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী

বসন্তবৌড়ির ডাক
সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী



অনেকদিন পরে পাপড়ি খুলে গেল,
কেমন আছিস বসন্তবৌড়ি?

এখন বিকেল দেখিনা রঙীন
বিকেলগুলোয় ধার নেই আর
এখন সোজা কথা বলতেও
ভুলভাবে নেশাগ্রস্ত হই,
থাক যত বাজে কথা -
কেমন কাটালি ঐ বিহীনসময়?

শেষবার ঝগড়ায় ভুলেই ছিলাম
তোর অনাথ বাড়ির চলতি গল্পকথা
তোর অনর্থক বন্ধুত্বের অপছন্দ কাহিনীমালা।
থাক তেঁতো স্বাদ, আয়
গয়নার বাক্স নিয়েই কথা শুরু হোক
কিম্বা তোর অহঙ্কারী বাবা বিষন্ন মা,
সেই হারানো বিকেলের মতোই।

আয় আবার শেষ পীত আলোর কণা
গায়ে মেখে ফুচকার জলের বিন্দু
চেটে নিই তোর আঙুলের গোলাপী আভায়।
এখনো মনখারাপী শুষ্ক আবহাওয়া ঘিরে
শ্বাসকষ্ট তোর কল্পবিলাসে!

এ নিস্পৃহ সময় কাটিয়েছি দুস্থ রামের গ্লাসে,
এই কবছর বসন্তবরণ ভিআরএসে ছিল
সারাটা সময় জুড়ে শুধু শীত শুধুই বরফপাত।

শুধুই বলার থাকে সারা দিনমান?
শুধুই কি কাজের কথায়
প্রত্যাশায়
নষ্ট করি এ প্রান্তসময়?
আজকাল সব কিছু থেকে যায়
অনুভবে
বুকের অদৃশ্য তানপুরায় কবে
যেন বেজেছিল সূক্ষ টোড়ির তান
জাননা তুমি?

আর আজ ফিরেই যদি এলে -

যা চলে গেছে, ফেরে না কেন কিছুতেই...!

কবিতা - ঝুমা মজুমদার

একটা সাদামাটা গল্প 
ঝুমা মজুমদার



কোনদিন আগুনে পুড়তে শিখি নি
গলতে পারি নি বরফের মত অকপটে 
শুধু নতজানু চিলেকোঠার প্রথম বর্ষার কাছে
পরাজিত সৈনিকের বেশে ।

ভেজা জবজবে শরীরটাকে আস্তে আস্তে ঠেলে দি
শতছিদ্র ঘুণেকাটা ইতিহাসের পাতায়,
হলদেটে মলাটের ভাঁজে,
খোলা চুলে আমার অতীত
তোমার বুকে মুখ গুজে
নিশ্চিন্তে !

আজ যদি ফের বৃষ্টি আসে তালাবন্ধ চিলেকোঠায়
গুমোট মেঘের বুক ভেঙ্গে
ঝাপসা চোখে ছুঁয়ে দেখো,
আঙ্গুলের ডগায় এক চিলতে অতীত কে
স্পর্শে, গন্ধে, অনুভবে ...

কবিতা - সৌম্যেন্দু হালদার

দুটি কবিতা
সৌম্যেন্দু হালদার



জীবন একটি স্বপ্ন

স্বপ্নের শেষে হাতটি বাড়িয়ে দাও।
আগে যেভাবে দিতে।
এসক্যালেটারে বেসামাল হয়ে পড়লে।
নৌকা একটু বেশি দুলে উঠলে।
দূরপাল্লার ট্রেনে চড়ে বসলে।
যখন জীবন কথা বলে তখন কেউ ফুরিয়ে যায় না!
কেননা ও শুধু বেঁচে থাকার কথা বলে।
যদিও বাঁচতে বাঁচতে এমন একদিন আসে
যেদিন পাগল হৃদয়টা আর হাত বাড়িয়ে দেয় না।


আর্জি

সে তোমাকে ছুঁয়ে আছে তুমি তার কাছে যাও।
সে তোমাকে খুঁজেছে কিন্তু পায় নি, তার কাছে যাও।
তোমাকে আঁকড়ে ধরে বেড়ে উঠেছিল যারা
তাদের ও বাঁচিয়ে রাখবে বলেছে
আর অন্য পথগুলিকে পথভ্রষ্ট করে দেবে বলেছে।
তুমি ওর কাছে যাও।
ও জানে তুমি চলে যেতে পারো।
তাই শেষবারের মতো ও তোমাকে
রজনী শেষের প্রদীপটির কথা বলেছে।
হয়ত আর কোনও কথা কোনোদিন বলতে পারবে না।
তুমি ওর কাছে যাও।

কবিতা - অরুণ সেনগুপ্ত

ঈর্ষা
অরুণ সেনগুপ্ত



ঈর্ষাকাতর চোখ রোজ হেঁটে যায়
তিনতলা বাড়ি ওই - সাদা দেওয়াল
পায়রা ওড়ে দুবেলা ; শান্ত ঘুমায় ।
অদৃশ্য ধারহীন এক তরোয়াল
সুনিপুণভাবে খালি মর্মে খোঁচায় ।
পানের লতিকা ফেলি গা মেটাতে ঝাল ।
ফিরতে আসতে যাই ; শরীর গোলায়
নিজের মনেই নিজে দিই গালাগাল ।
ফুটফুটে দেওয়াল ঝিলিক রৌদ্রে
আছাড়ি পিছাড়ি ঢেউ খেলে যায় রোজ
বোলাই কালির তূলি হিংস্র আঁচড়ে
ক্ষত করি , তার নেই কোনই গরজ ।
কেমন আকাশে ওড়ে ; উড়েই তো যায় -
ঈর্ষা চোখ যতই সিঁড়ি টপকায় ।

কবিতা - পৃথা রায় চৌধুরী

চন্দ্রাহতা
পৃথা রায় চৌধুরী



অপরপক্ষের দেওয়ালে সিঁদুরে স্বস্তিক জানান দিয়েছে
তোমার কাছে, বাজি রেখেছি অপার আশার এক সিন্ধু অনন্ত
তীর ধনুক শিশু শেষটা প্লাস্টার জড়ানো বোকামির দায় নিয়েছে;
সশব্দ তাগিদে ফুটে ওঠে শুধু উৎসাহী আকুলতা,
চোখ দাও মনের মতো করে, যেখানে হাওয়ারও রঙে
বাঁধা থাকে পুনর্জন্মে তোমাকে পাবার মানতনুড়ি।

স্থির আয়নায় গতিশীল হয়ে যায় ছবি,
অন্তহীন মধ্যরাতে সুর তোলে সর্বনাশী কুহকিনী
সম্পর্ক কন্ট্র্যাক্টে সৃষ্টিকর্তার দায়সারা সই মেলে না;
মন দিয়ে নাড়ির টানে ভালোবাসা উল্কি ফোটাবো
আসন্ন স্নানকালে স্খলিত বর্ম অস্বাভাবিক সুস্থির,
চাঁদ টেনে নেয় ভেঙে পড়া বাঁধের সংযমী নুড়ি অনায়াসে।

কবিতা - বর্ণালী গুপ্ত

ইনটারমিসন
বর্ণালী গুপ্ত



শেষ বিকেলের বৃষ্টিধারা আমাকে নাও
স্পর্শ স্নানে ধুয়ে দাও আমার বিগত শোক তাপ
নীলাভ জ্বরো রাতের অনুভুতি মাখা গান,
নিজের অজান্তেই লেখা নিষিদ্ধ অনুভব,
আজ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের ধাতব খাঁচায় সঙ্গাহীন।
কত না লেখা কবিতার পংক্তি,কত না দেখা দৃশ্যের অনুরণন,
কত সুর স্পন্দ্‌ন রাগরাগিণীর নিখুঁত চলন।
সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে দাও সেই অনুভব
জীবনের তুচ্ছ খাঁচা বন্দী পাখি ডানা ঝাপটে নিজেই
আকাশ হয়ে উঠুক ...
নীল আকাশ.......আমাকে নাও।

কবিতা - নাশিদা খান চৌধুরী

প্রবোধ
নাশিদা খান চৌধুরী



মনি-মুক্ত, সমুদ্র সেঁচে
এক বালতি বিষাদ কুড়োনো গেল
দেনা পাওনার শেষ বিকেলে;

আকাঙ্ক্ষায় কিছু জটিলতা ছিল
লোভ ছিল তার চাইতে বেশী।
তীক্ষ্ণ নজরে বাদ পড়েনি বাড়তি উচ্ছৃংখলতা
বিষবাষ্পে মজে যাওয়া কিছু কথপোকথন...
শুধু মুখ বুজে সয়ে যাওয়া সেচ ভূমিকা।

গোঙানো রাতের ফেটে যাওয়া কর্ণকুহরে
শ্রবণেন্দ্রিয় জাগ্রত করে, আড়চোখে দ্যাখে -
খেলতে খেলতে পুড়ছে তমসার প্রহর।

ইচ্ছে করে,
বিষাদের সাথে ছাই মেখে বিষিয়ে দি লোভীমুখ
অনর্গল লাঙল চালিয়ে প্রতিশোধ নেই নোনাভূমিতে
অট্টহাসি নিয়ে দেখে নেই শেষ অধ্যায়ের রঙ্গমঞ্চ
জিঘাংসার সুত্রপাতে নিরাময় হোক;

আহ্! পারিনা...
উল্টো, প্রতিনিয়ত উত্তাল ঢেউ-এ জলাঞ্জলি দেই কাপুরুষ মন। 


কবিতা - আলি রেজা

প্রখর শিকারী
আলি রেজা



দুপুরের দহনকে আঁচলে গিট মেরে কিশোরীটি ঘাসফড়িংয়ের পিঠে চেপে বসে। শস্যখেতে কলসীর কণা, রক্তের ঘ্রাণ পাই আলপনা আঁকা পায়ের গোলাপি ডিমে, রুপান্ধ কিশোরীর মুখে মাদলের কাঁপন, লাভার স্রোত কোন চিহ্ন রাখেনি তার তামাটে উদরে, অনতিগভীর নাভির পাড়ে সোমত্ত পলির স্তর।

ভো-কাট্টা ঘুড়ির সুতো ধরে আকাশে উড়াই, আমার কখনো না্টাই হলো না। আর স্পর্ধা কেন?

সন্ধ্যা হলেই ফিরে আসি মাটির ডেরায় পূর্ব-পুরুষের প্রত্নভূমি, এখানে প্রতিটি রাত প্রখর শিকারী।

কবিতা - আব্দুল্লাহ্ জামিল

কবিতা ত্রয়ী
আব্দুল্লাহ্ জামিল


বিরহের নেশা

এবং কেউ চলে যায় আজ
বহুকালের না বলা কথা বলা হয়ে যায়
মরণের বহুকাল আগে
অতঃপর বিচ্ছিন্ন সংযোগ

তখন মেঘলা আকাশের হেঁয়ালিপনা
কখনো কখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝরে
কখনো হাল্কা রোদের পরশ বুলায়
কিংবা ঝমঝম বৃষ্টিতে ভেজায়

তারপর ভুলে যাওয়া পথে
চলতে চলতে চলে যায় বিস্মৃত জগতে
এই প্রেমের গান গাইনি কোনদিন
অথচ বিরহের গানও কতো আনন্দদায়ক

না কিছু আশা করতে নেই
তাতে শুধু কষ্ট বেড়ে যায়
আমি তো আর কষ্ট চাই না
এখন বিরহের নেশায় বুঁদ হয়ে আছি


ক্ষুধাচিত্র

লাজ-লজ্জাবিহীন এই রাঁধুনী নির্ভর ক্ষুধা ভালো লাগে না
অত বকবক করা কেনো?
নির্লিপ্ত সূর্যটা শুধু জ্বালা ধরানো কিরণ ঢেলে যায় মনে
আর ভালো লাগে না এ’ অসহ্য পরনির্ভর ক্ষুধা
অথচ দেখেছো দেশখেকো রাজনীতিকেরা আজ
সুন্দরী গণিকার যোনি চেটে তৃপ্তির ঢেকুরে করছে ক্ষুধা নিবারণ!

এখানে তো শুধু আত্মঘাতী ক্ষুধায় কাতর মানুষের দল
একে অন্যের সব ইচ্ছেগুলোকে চিবিয়ে চিবিয়ে
আখের নিরস ছোবড়া বানিয়ে ফেলে
আর নিরাশার ঘুম চোখে আশা পূরণের ব্যর্থ স্বপ্ন দ্যাখে।


সম্মানী

বৃদ্ধ এ’ বালুকা বেলায় তরুণী ও যুবতী ঢেউগুলো
কেমন আছড়ে আছড়ে পড়ছে আজ
আয়নাতে মুখ দেখি রোজ
শ্যাওলা পড়া দেয়ালেতে চুনের ছিটা লেগে আছে
এ’ দেয়ালে প্রেমালেখ্য লেখা যাবে না
কি করে বোঝাবো
এ’ ভালোবাসার উপযুক্ত সম্মানী আমার কাছে নেই

কবিতা - আহমেদ মুনীর .

বোধ 
আহমেদ মুনীর .

এক লাজুক প্রহর জেগে ওঠে বোধে
পরাভূত হয় প্রতিবার অনুভূতি নিদ্রা
চপলা হরিণী তার সঙ্গীর কপোলে নাকে মুখে
মুক্তোর ঝিলিমিলি স্পন্দিত স্নিগ্দ সরোবরে
পারিজাত পুষ্পে বিমোহিত স্পর্ধিত উল্লাসে
বুনো গন্ধে পৃথিবী থেকে ইউটোপিয়্যান নক্ষত্রলোকে
প্রবাহমান মৃত্যু দুঃখ ও যন্ত্রণার স্রোত
তবুও রৌদ্রের রঙ ছড়ায় বিস্তৃত মাঠে বনভূমে
চারদিকে ফসলের বীজ
এই মাটি ঢের ফলবান খরস্রোতা নদী
এখানে সহস্র প্রাণারাম আসে
শালিক দোয়েল আর হরিণের পাল
গতিশীল নভোনীলা এখানে কিছুটা কাল ভালোবেসে
লুফে নেয় উষ্ঞ সুখের মৃম্ময়ী আঁশ ।।

আশ্চর্য! একবিংশ শতাব্দীর এই পরম চরম দিনেও
পরমাণু এবং অতি-জনন তত্ত্বেরও উর্ধে
পাথরে পাথরে আগুন জ্বলে যন্ত্রণা বাড়ে
তবুও পাথর বিগলিত হয় না মোমের মত
তবুও জ্বলে যন্ত্রণায় উত্তাপে
নীল কঙ্ক্রীটে সুবিন্যস্ত এই আবার কেমন পাথর
কে জানে কে জানে ।।


তবুও শব্দকে ধরে রাখি
জীবন আর চেতনাবোধে অঙ্কুরিত সভ্যতার লোভে
শিল্প ও কবিতাকে আশ্চর্য ও অলৌকিক বিন্যাসে
আমি সাজিয়ে রাখি আমারই উদ্যানে অন্তরীক্ষে
বুকের মধ্যে হৃদয়ে বাজে সারাক্ষণ
আদিম ও সনাতন
ক্ষয়িষ্ঞু আভার মত
সেই এক নাছোড় অনুগ্র বোধ ।।

কবিতা - মেঘলা জান্নাত

কবিতার সুরে তীব্র ঝঙ্কার
মেঘলা জান্নাত



কবিতা তবে কি?
যেমনি মানুষ উদঘাটন করেছে বহু সত্য
রচনা করেছে যুগে যুগে অনেক তত্ত্ব
তবে কি এমনি করেই জন্ম নিয়েছিল শিল্পকলা
আর তারই অন্যতম সৃষ্টি এ কবিতামালা ?

কবিতা তবে কি?
কল্পনার অসীম মূর্তরূপে বিরাজমান
গভীর অনন্তকে পাঠকের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যে সচেষ্ট শান
তবে কি তেমনি প্রচেষ্টা এমন কবিতা লেখার প্রয়াস
এমতাবস্থায় কবিগন কি কেবলই ফেলবেন দীর্ঘশ্বাস?

কবিতা তবে কি?
অনুভূতির সুন্দর ও শাশ্বত প্রকাশই যদিবা পাঠকের কাছে কবিতা হয়
পাঠক নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারলেন কিনা তা-ই বিচার্য বিষয়
গন্তব্য কোথায় কবিতার?বা কবিতা কি সকলের জন্যে নয় ?
কবিতার সূক্ষ শরীরে রক্তের আঁচড় কেটে ফোটা অস্ত্রাঘাত !
যেমনি করে"স্বাধিনতা"নিয়ে সৃষ্ট কবিতা হয়ে উঠেছে,লেখনী নির্ঝরে বজ্রপাত ।

কবিতা তবে কি ?
নির্দিষ্টস্থান কোথায় কবিতার?নাকী এ এক দখল করা জমিন?জমিদারের ।
কারাইবা দিয়েছিল কবিতায় ব্যাপক রূপ!চক্ষুকর্নরঞ্জক লোমহর্ষক সব আবিস্কারের!
পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক,তবে কি দূর্বোধ্যতাই কবিতার অলঙ্কার ?
কি করেইবা হয়েছিল উদয় স্রোষ্টারূপি কবিমনে অহঙ্কার ?
কবিতায় যেন আজ রক্তশূন্যতার শঙ্কা!
কে করবে এর ভবিষ্যৎ রক্ষা?

এবার কি তবে পারবেনা প্রজন্ম,কবিতার গায়ে লাগাতে তীব্র ঝঙ্কার!

এবার হোক তবে কবিতা..................
শৃঙ্খল মুক্তির জন্যে কবিতা,
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা,
গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা,
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা,
স্বাধীনতার পক্ষে কবিতা,
ভালবাসার আহব্বানে কবিতা.......

কবিতা - শ্যাম রায়

জয় মা  আগমনীশ্যাম রায়



পৃথিবীতে আগুন
আগুনে পৃথিবী
কোনটা ?

বিষাদের স্বপ্ন
স্বপ্নে বিষাদ
ক্ষণটা ,

শরতের প্রকৃতি
প্রকৃতিতে শরৎ
মনটা~

কাশে দোল
দোলে কাশ
ঢেউটা ...

প্রভাতে শিউলি
শিউলি প্রভাতে
গন্ধটা ...

বীরেনবাবুর ভোর
ভোরে বীরেনবাবু
প্রাণটা !

আশ্বিনের শারদপ্রাতে
শারদপ্রাতে আশ্বিন
ঘণ্টা ...

আগমনী বাতাসে
বাতাসে আগমনী
সুরটা ...

জাগো দুর্গা
দুর্গা জাগো
রেশ টা.....

সবার ভালো
ভালোয় সবে
শেষ টা ...।।


কবিতা - সন্দীপ দাশ

অনাবৃষ্টি
সন্দীপ দাশ


বৃষ্টি এলো না !!!
বৃষ্টি এলো না......
অথচ, এক পশলা বৃষ্টির ভীষণ প্রয়োজন।
সব ধুয়ে মুছে গেলে
সারাদিনের অস্বস্তি কিছুটা অন্তত কমে—
তবু, বৃষ্টি এলো কই......
পাশের বাড়ির মঞ্জুলাদি আজ
অনেকদিন পর হাওয়াইন গীটারে গান তুলছে,
“এবার নীরব করে দাও হে তোমার......”
ওপাশের বাড়ির তন্ময় সকাল থেকে দরজা এঁটে বসে।
সকালের পেপার বলছে,
মেয়েটা হাতের শিরা কেটে বৃষ্টি আনতে চেয়েছিল...
সকলেই বৃষ্টির খোঁজে,
তবু, বৃষ্টি এলো কি?
ক’জনের জীবনেই বা বৃষ্টি আসে?
যাদের এলো বা আসবে,
তারা অঝোর ধারায় ভিজে নেয়
বারংবার আর আমাদের,
যাদের জীবনে বৃষ্টি এলো না, তারা,
ঘণ্টা- মিনিট- সেকেন্ড গুনতে গুনতে
আরও বেশি অস্বস্তির দিকে এগিয়ে চলেছি......
ক্রমশই......
বৃষ্টিহীন আকাশে খুব তাপ। ...
তা তুমি জানবে কেমন করে?
তোমার আকাশ তো কোনদিন তাপমান নয়।
তোমার আকাশে আসে শীত আর বসন্ত;
শীতে পাতা ঝরিয়ে বসন্তে আবার নতুন পাতা...
তুমি কি বুঝবে বৃষ্টিহীনতার কি জ্বালা???

কবিতা - সুবর্ণা গোস্বামী

ক্ষত
সুবর্ণা গোস্বামী



এরকম হয় মাঝে মাঝে,
শিকারী পাখির কাছে অনুরোধ করি
বিঁধে থাকা সূচ খুলে দিতে,অরব শরীরময়।
যন্ত্রণার জলচৌকি চৌচির তবু
থামবার নয় তার অমোঘ নখর,
জলসাঘরের রঙিন জানালার কাচে
চোখ রাখলে দেখা যায়
হাড়,মাংস প্রনয়ের ক্ষত,
ধূপের নিহত নিঃশ্বাস,
অলিতে গলিতে পড়ে থাকা হৃদয়ের মৃতদেহ আর
বিষের পেয়ালাটিকেও।

এরকম হয় মাঝে মাঝে,
মাঝরাতে বুকে ভর দিয়ে উঠে আসে স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপ
বুকের উপর নিয়ে ঘুমিয়ে থাকি
দেখি সে আমারই মতন কেউ,সহোদরা?
কখনও স্নেহের চিরুনী দিয়ে আঁচড়ে দেই চুল,
কখনও কৌশলে চোরাবালিতে ফেলে
দেখি মুগ্ধ চোখে নিঃশেষে ডুবে যাওয়া তার।
দাবদাহ, সূচ আর ঘৃণার চুম্বন,
ফিরে ফিরে আসে
তারা তো মানুষ নয়,
আমাকে একলা ফেলে কি করেই বা যাবে?

এরকম হয় মাঝে মাঝে
যত্নে লুকিয়ে রাখা অমরত্বের কবচ
ছুঁড়ে দেই অসুখের পায়ের উপরে।

কবিতা - মনোজিৎ দত্ত

সত্যের শস্য দানা
মনোজিৎ দত্ত



যতই লাঙ্গল দিই...আমার শব্দগুলো
জল - মাটি -কাঁদায় ঠিকঠাক মেশেনা
খুব একটা ভাল ফলন হবেনা জানি
তবুও কবিতার প্রান্তিক চাষীতো ...
ঘাম ঘাম চেষ্টার খামতি নেই।

জানি ... সব ঋতুতেই
কবিতার কমবেশ ফলন হয়
একেক ঋতুর একেক স্বাদ।
আমিও চেষ্টা করি ...
তবুও আমার শীতের কবিতা -
গরমে ঘেমে উঠে
আমার গরমের কবিতা ... শীতে জুবুথুবু।
কোকিল বসেনা বসন্তে কবিতার ডালে
ঝুলে থাকে আত্মঘাতী কৃষকের লাশ
শরতের সাদা মেঘের ভেলা বিবর্ণ
তবুও ঘাম ঘাম চেষ্টার খামতি নেই।

প্রেমের কবিতা লিখলে
লোকে বলে - এটা সুইসাইড নোট
বিপ্লবের কবিতা যেন শোকপ্রস্তাব
প্রতিবাদের কবিতা জঙ্গী হয়ে উঠেনা
শব্দেরা যেন শবযাত্রার মৌনমিছিলে।
জ্যোৎস্নার কবিতায় সূর্যের বিদ্রুপ
... চাঁদও যে সূর্যের কাছে ঋণী
বৈরী-বাতাসে স্বপ্ন-চোখে অন্ধকার।
তবুও ... ঘাম ঘাম চেষ্টার খামতি নেই।

আমার ঘাম ঘাম চেষ্টার খামতি নেই
আসছে দিনে -
অন্ধকারে না ... অন্ধকার পুঁতবো
লাঙ্গলের ফলায় - কবিতার শরীরে।
সত্যের হাজার ওয়াট হ্যালোজেনে
জমাট অন্ধকার কবিতা হয়ে উঠবে।

জমাট অন্ধকার 'কবিতা' হয়ে উঠবে।

কবিতা - স্বাতী বিশ্বাস

রূপকথা
স্বাতী বিশ্বাস



কোথায় গেল রূপকথারা তেপান্তরের মাঠ
ক্যামন করে হারিয়ে গেল মুন্সিগঞ্জের হাট।

অরুণ বরুণ কিরণমালা বুদ্ধু ভুতুম সোনা
নীলকমল আর লালকমলের স্বপ্নে আনাগোনা।

ডালিমকুমার ক্যামন করে লুকিয়ে ডালিম গাছে
রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে রাখতো নিজের কাছে।

সোনার কাঠি রূপোর কাঠি জীয়ন কাঠি হয়ে
দেশের মানুষ উঠত বেঁচে আবার হেসে গেয়ে।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী আর সাত সমুদ্র নদী
হীরের গাছে মোতির ফুল নানান রঙের ছবি।

ঠাকুরমায়ের ঝুলির থেকে কতই গল্প কথা
স্বপ্নে এসে দেখা দিতো সোনালী রূপকথা।

রাক্ষসেরা যাতেই হারে  রাজপুত্রের কাছে
এটাই শুধু কাম্য ছিলো ভুল না হয় পাছে।
কেউ শোনেনা ওসব  কথা  নেই যে ঠাকুরমা
নিজের গাছ কাটছি নিজেই মুড়িয়ে নটেখানা ।

রাজপুত্তুর পালিয়ে গেছে পক্ষী রাজে চেপে
তাইতো আঁধার লেগে আছে এই বৃত্ত ব্যপে।

কবিতা - সিধ শর্মা

নিরুপায়
সিধ শর্মা



অস্তালয়ে নির্ঝরিণী পারে
প্রতিবিম্বিত মুখ মনে করে
ছিল সে কোনদিন মধু সঞ্চারিণী বনিতা
সুখপল্লবিনী মাধবীলতা
কষ্ট নিমজ্জিতা বধূ
কবির স্বপ্নঘরণী কবিতা।

বুক ঘসটে সরীসৃপ অতীত ফেরে
বর্তমানের দ্বারে
জ্বেলে বহ্নিশিখা অঙ্গারিত চিতা
সিঁদুর লিখন অবগুন্ঠন পারমিতা
তীব্র দহন ধূ ধূ
ভবিষ্যত হতচকিতা।

ক্রুদ্ধ রূঢ় বাস্তব রোষানল
লেলিহান শিখার দাবানল
বর্ণহীন গন্ধহীন শতদল
স্তম্ভিত ধূসর মরু ভূতল।

দূয়ারে ভালবাসা দীপ নিভে যায়
স্বপ্ন, প্রেম হতবাক নিরুপায়
চুক্তিপত্রে সীলমোহর দিয়ে যায়
অর্ধদগ্ধ অস্থি চিতা শয্যায়।

কবিতা - শফিক আমিন



জীবনমুখী গান
শফিক আমিন




এই রাত শাশ্বত হবেনা জানি
খুণসুটি প্রেম রানীক্ষেত রোগে আক্রান্ত মুরগীর মতো
ঝিমোবে। হয়তো কোনো নতুন সুখে তুমি হবে
আচ্ছন্ন; থাকবেনা কৌতুহল- কেমন আছি, কী করছি
নতুন কোনো কবিতা হয়েছে কিনা।
তখনো কবিতা হয়তো হবে লেখা
জলহীন বালুময় সাগরের মতো,
তুতেনের মমির মতো, নীরস বেলপাতার মতো
অথবা বালু কিংবা তুষার বরফ ভাস্কর্যের মতো।

প্রতি রাতে গভীরতা মাপি
প্রেমের ঢেউ এসে ঘুম ভেঙে দেয়, রঙিন জ্যোৎস্না
সুখ ঢালে প্রাণে। ঝলমলে আরো কতো স্বপ্ন -
দুটো বাদামি হাত সোহাগে ভরিয়ে দেয় মন,
শান্ত হাঁসের মতো দুটো চোখ শীতল করে চেখের
দগ্ধতা; একজোড়া ঠোঁট আর্দ্রতায় নিভিয়ে দেয়
বিরহ অনল।

ধীরে ধীরে চাঁদ ডুবতে থাকে
ডুবতে থাকে আগত সূর্যের রশ্মিতে পরা¯ত হয়ে।
এমনি চক্রাকারে চাঁদক্ষয়ের আয়ু নিজের ভেতরে
জাগাবে অমাবস্যার কালো।

যখন জানবে, এই আধার গিলছে তোমার চাঁদ
হয়তো তখন অজান্তে একটা ধাক্কা দিবে
পুরোনো সেই প্রেমঢেউ...!
হৃদয় ছাউনিতে ঝরবে শিশির ফোটা, আধারের ভেতর
উড়িয়ে দিবে গোপন দীর্ঘশ্বাস,
স্মৃতির বোঝা হালকা করে আগামীর পথে ছড়িয়ে দিবে
নতুন সুরের জীবনমুখী গান।

কবিতা - নাফিসা ইসলাম

চিঠি
নাফিসা ইসলাম



তোমাকে রাখিনি তো বন্দি করে
এই মনে ভালবাসার কারাগার গড়ে;
আমাদের ভালবাসা তোমাকে দিয়েছে
অপার স্বাধীনতা উজাড় করে।

তুমি উড়ে যাও; যেমন করে
ভুবনচিল স্বাধীন ডানা মেলে
মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যায়
আকাশের আরও ওপরের আকাশে
বৃত্তাকার পথে; এক বিন্দুটি হয়ে
পৌঁছে যায় দৃষ্টির শেষ সীমানায়-
তুমি তেমন করেই উড়ে যাও ঐ আকাশে।

আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি-
যেন, যেতে চাও সূর‍্যের খুব কাছাকাছি-
ভরে নিতে সূর‍্যের যত আলো, তার বর্ণচ্ছটা -
তোমার দু'চোখে, ডানায়, পালকের ভাঁজে ভাঁজে।

মনের দুয়ার আগলে আমি অপেক্ষায় থাকি
তোমার সেই সূর‍্যোজ্জ্বল রূপ দেখব বলে-
কেমন করে তোমার পালকের ভাঁজে
জড়িয়ে থাকা সোনালী আলোর কণা
ছড়ায় স্বর্ণালী দুতি ! তার ছটায়
তোমার দু'চোখে রংধনুরর সাত রং
কেমন করে খেলে যায়! আমি থাকি
তারই প্রতিক্ষায়, প্রতি সাঁঝে।

যখন অন্য কোন আকাশে
সূর‍্য তার আলো ছড়াবে বলে
দিগন্তরেখায় মিলাবে; 

আমি জানি, 
তোমারই রচিত বৃত্তের পরিধি ধরে
তুমি আসবে ফিরে এই মনের ঘরে।
আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুধু দেখব তখন
তোমার অপরূপ সে রূপ নির্নিমেষে,
আবেশিত হব, সমর্পিত হব-
তোমাকে ভালবাসার অনুভবে।

যদি কোনদিন তুমি নাও আসো
ফিরে এই মনের দুয়ারে;
দুঃখ পাবো না যেনো; জানবে তখন
তোমাকে ভালবেসেই আছি বেঁচে।
আমি জানবো- তুমি আমারই আছো,
যেমন তুমি আমারই ছিলে।।