কবিতার পরিবারের একমাত্র ব্লগজিন

এখনও পর্যন্ত  Website counter  জন ব্লগটি দেখেছেন।

শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২

গল্পকথা - সায়ক চক্রবর্তী

চিহ্ন


বেঁচে থাকার সংজ্ঞা সম্পর্কে তখনও একটা সুস্পষ্ট ধারণা জন্মেনি। বয়স নিতান্তই কম হওয়ায় এইসব গুরুগম্ভীর বিষয় মাথায় ঢুকত ঠিকই কিন্তু স্থায়ী হত না। এভাবে এক একটা বসন্ত আসা যাওয়া করছিল নিজের মনে। আমাদের পাশের বাড়িতে এক নতুন ভাড়াটিয়া এলো। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই কি ছুঁই, ভদ্রলোকের নাম তরুণ রায়, ধাম কলকাতা কিন্তু এখানে এসেছেন একটা যে কাজে সে কাজের জন্য আমাদের এলাকা সত্যি যোগ্যতম। কাজটা হল লেখালেখি। আমাদের এলাকা নন্দন কানন না হলেও দু একজন দেবতুল্য মানুষ আসেন বটে বেড়াতে। প্রকৃতি যেন নিখুঁত করে সাজিয়েছে এই গ্রাম। আমি রক্তিম। আমি আপাতত বাবার হোটেলের ভাত ধ্বংস করে সেই শক্তিতে দু একটা কবিতা গপ্প লেখার চেষ্টা করছি দিনরাত আর তাই একটু আধটু বুঝি। তরুণ রায়ের লেখা যখন আমি পড়লাম তখন যেন হাতে স্বর্গ পেলাম। হাতের কাছেই গুরুদেব, বৃথা দৌড়ে কাজ কি? আমি প্রায় ওনার চ্যালা হয়ে গেলাম। এরকম দক্ষতা এবং সাহিত্যের উপর দখল আমি এর আগে কাউকে দেখিনি অথচ ভাগ্যের গায়ে শ্যাওলা পড়ে পিছলে গেছে খ্যাতি। নাম নেই একফোঁটা, কিন্তু এতে তার দুঃখও নেই। অনেকবার উনি চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠানোর, কোথাও ছাপেনি। উল্টে কোন কোন জায়গা থেকে তো এমন উত্তর এসেছে যে আমি হলে পিণ্ডি চটকে ছেড়ে দিতাম সম্পাদকের। একদিন জিজ্ঞেস করলাম – ‘ আচ্ছা জেঠু, জীবনের উদ্দেশ্য কি?’ তিনি বললেন – ‘ জীবন মানে চিহ্ন’। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম ওনার মুখের দিকে। ভাসা ভাসা কিছু তরঙ্গ আমার মননকে ছুঁয়ে গেলো।সেদিন আর কোন কথা হয়নি। উনি একটা পত্রিকায় লেখা পাঠাবেন বলে একটা গল্প লিখছিলেন। আমি বলে উঠলাম – ‘আবার পাঠাবেন? এরা তো আপনার লেখার কদর বোঝে না!, উনি একটু লিখে ; বললেন – ‘একদিন বুঝবে - শেষদিন বুঝবে।‘ আমি আবার থ হয়ে গেলাম। আর বাক্যব্যায় না করে বাড়ী ফিরে এলাম। এভাবে দিনের পর দিন ওনার সান্নিধ্য পেয়ে তখন আমিও একটু পাতে দেবার মত লিখতে শুরু করেছি। অনেকগুলো বছর এভাবে কেটে গেছে যেমন যায়।

সেদিন খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি সন্ধ্যায় জেঠুর বাড়ী গিয়ে দেখলাম – কলম চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে। আশেপাশের লোকজনদের খবর দিলাম। এরপর কয়েকমাস কেটে গেছে। হঠাৎ একটা জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায় দেখলাম ওনার লেখা ছাপা হয়েছে। দেখে যে আনন্দটা পেলাম সেটা চোখের জলের সাথেই ধুয়ে চলে গেলো। কয়েক সপ্তাহ পর আবার একটা লেখা... এভাবে প্রায় দু তিন মাস পর এখানে ওখানে ওনার লেখা... আলোচনা... বাড়িতে বুদ্ধিজীবীদের ঢল... পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ... চলল ২ বছর আরও। এখন তরুণ রায় বাংলার অন্যতম এক খ্যাতনামা সাহিত্যিক। দুদিন আগে আমি অফিস থেকে এসে যথারীতি চা খাচ্ছি আর বই নিয়ে বসেছি। হঠাৎ মনে হল – ‘ আমি ওনাকে কি কম ভালবাসতাম নাকি শ্রদ্ধাভক্তি কম ছিল? তেমন তো অভাব বোধ করছি না! কারণটা কি!’। টেবিলে ওঁর লেখা বইয়ের স্তূপ দেখে উত্তর পেয়ে গেলাম। আমি আজকাল অফিসে যাই না। আঁচড় কাটি সাদা পাতায় যদি একটা দাগ স্পষ্ট হয়ে। ইচ্ছে করে আমারও টেবিলে পড়ে থাকতে – উদাস অথচ উজ্জ্বল!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন