কবিতার পরিবারের একমাত্র ব্লগজিন

এখনও পর্যন্ত  Website counter  জন ব্লগটি দেখেছেন।

বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১২

কাশীনাথ গুঁই

সুরভী


মধুমতীর বাঁকের ছোট গাঁয়ের চাষার ছেলে অনি।ওর বাবা পণ্ডিতমশায়ের ভাগচাষী।অনিকে পরের জমিতে ঘাম ঝরিয়ে তেভাগার অকাট মুখ্যু না হতে হয় এই ছিল তার আশা।তাই হাতে পায়ে ধরায় অনিকে ভর্তির ব্যবস্থা করেন পণ্ডিতমশায়।সে ছেলে যে আধপেটা খেয়ে মলাটহীন আধছেঁড়া বই ঘেঁটে ফিবছর ক্লাসে ফার্ট হবে কে জানতো সেকথা।

সুরভী পণ্ডিতমশায়ের বড় নাতনী। সে এখন ক্লাস এইট। ছোটবেলা থেকেই পাড়ার ভাল ছেলে অনির কাছে পড়ার সময় পড়া বুঝেছে এক্কাদোক্কার সাথী হয়েছে।পড়া শেষে সূয্যি পাটে বসার সময় মাঠের ধারে দিঘির পাড়ে বসে ঘাস চিবোতে চিবোতে সূয্যিটাকে দিগবলয়ে লুকোচুরি খেলতে দেখেছে।মধুমতীর বুকে নৌকা বাইচের উত্তেজনায় বুকে হাপর টানতে টানতে অনির পিঠে মুখ লুকিয়েছে।

অনির মাধ্যমিকের বছর সুরভী ক্লাস নাইনে উঠতেই তার বাবা তাকে নিয়ে গিয়ে কর্মস্থল কলকাতার এক ভাল স্কুলে ভর্তি করে দিল।পূজোর ছুটিতে এসে সুরভী অনির পরীক্ষায় লেখার জন্য পার্কার ফাউন্টেন পেনটা দিয়ে ওকে মনে রাখতে বলেছিল।ভাইফোঁটার বিকেলে নদীর পাড়ে গিয়ে ঘটিম দিয়ে মুক্ত অক্ষরে নিজের নামটা মন্দিরের দেওয়ালে লিখে অনির কানে কানে কি যেন বলেছিল।

পরদিন সুরভী কলকাতা চলে যাওয়ার আগে অনিকে টানতে টানতে আবার মন্দিরে নিয়ে গিয়ে হঠাৎ একটা প্রণাম করে হাত পেতেছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠোঁটে একটা গরম ছ্যাঁকা টের পেয়ছিল অনি। ততক্ষণে সুরভী হরিণীর মত নাগালের বাইরে।শহরে যাওয়ার সময় খেয়াঘাটে ফের একবার সুরভীর চোখে কি যেন পড়ে নিল অনি।সেই রাতেই অনির রাতজাগার হাতেখড়ি হল।

মাধ্যমিকের ফল গাঁয়ের মুখ উজ্জ্বল করলেও অনি আরও ভাল করতেই পারতো।তবু জেলার দ্বিতীয় স্থানটা ওর দখলে রেখছে অনি। তাই নারাণঞ্জের স্কুলে ভর্তি হতেও অসুবিধে হল না।কিন্তু কোঁচরে মুড়ি বেঁধে রোজ যাতায়াতে ওর শরীরটা বেশ ভেঙ্গে পড়ল।মনটাও ওর সঙ্গে শত্রুতা করতে ছাড়ল না।খেয়াঘাটে যাতায়াতে মন্দিরটা এড়িয়ে যাওয়ার পথ ছিল না যে।রাতের আকাশে তারাদের ভীড়ে সেই হাতপাতা মুখটা ওর ক্লান্ত শরীরটাকেও ঘুমের ঘরে যেতে দিতে চাইত না।

উচ্চ মাধ্যমিকের ফল শহরের সেরাদের মাঝামাঝিতে নামাল অনিকে।ফল বেরোনোর দুদিন আগেই ওর বাবা সাংসারিক মায়া ত্যাগ করে অনির ভাগচাষীর ছেলের পরিচয়টার সাথে দুমুঠোর ব্যবস্থাটাও কেড়ে নিল।অগত্যা অনি রোজগারের আশায় কলকাতামুখো হচ্ছে শুনে পণ্ডিতমশায় ডেকে পাঠালেন ওকে।কলকাতা শহরের জীবনে কত কঠিন প্রতিযোগীতা ও নিদারুন পরিণতি সেকথা বুঝিয়ে অনিকে নিবৃত্ত করলেন পোড়খেকো মানুষটি।ওনার পরিচিত নারাণঞ্জের একটা মোটর গ্যারজে শিক্ষানবীশ হিসেবে কিছু রোজগারের বন্দোবস্তও করে দিলেন তিনি।নাহলে সুরভী আর তার বাবা এ ছেলে উপর দুর্বল হয়ে আরও পড়াশুনার ব্যবস্থা করে দিলে বিপত্তি বাড়বে মোক্ষম। এ ছেলে যে একদিন জাতে উঠে তাঁর বংশে চুনকালি মাখাবে তা তিনি অনক আগে টের পেয়েই তো সুরভিকে কলকাতা ঠেলছিলেন।

মা আর বোনের দায় টানতে টানতেও অনি একদিন একটা গ্যরাজের সুযোগ্য মালিক হল বৈকি। বোনকে জেদ করে কলকাতাতেই সুপাত্রস্থ করলও সে।তখনই জানল যে সুরভি আর তার নেই।বোনের বিয়ের পর ওর মায়ের খুব শখ হয়েছিল বৌরান্না ভাত খাওয়ার।নানা অছিলায় অনির এড়িয়ে যাওয়াতে কারণ বুঝতেও দেরী হয়নি মায়ের।মেয়ের মেয়েকে আদর করতে করতেই এক বিকলে তার চোখে চির সন্ধ্যা নেমে এল।

বোনের আগ্রহে আর আপন মনের নিভৃত কোন বাসনার টানে অনি একদিন দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের পাশে তার ছোট্ট গ্যারেজ খুলে বসল।গুরুমশাইকে কথা দিয়েছিল অনি কখনও দখিন কলকাতামুখো হবে না। সেকথাও রেখেছে সে।অল্প দিনেই সুনামও এল তার।এল না শুধু সে, যার প্রতিক্ষায় তার এই মন্দির পাশে কাজের ছুতোয় বসে থাকা।

1 টি মন্তব্য: