ডায়রির পাতা থেকেঃ মন খারাপ
আমার খুব মন খারাপ হয়। সহজেই মন ভালো করে ফেলি, কিম্বা হুঠহাট কাঁদতে পারি, তাই বেশিক্ষণ মন খারাপ থাকে না। সেই আমারও কদিন থেকে মন খারাপ, কারণটা আর কিছুই নয়, মাথার চুল। এমনিতেই চুলে পাক ধরেছে, তার ওপর ভুসভুস করে রোজ চিরুনি ভরে চুল উঠছে। ভয়ের চোটে চুল আঁচড়ানো প্রায় ছেড়ে দিলে কি হবে, চুল উঠতে উঠতে ব্যাপারটা প্রায় “স্মৃতিটুকু থাক”-এর পর্যায়ে চলে গেছে। ক’দিন পরে রাস্তায় প্যাঁক খেতে হবে “নেড়ি যায় বেলতলায়।” অতএব সাত পাঁচ ভেবে মেয়ের প্ররোচনায় বেশ না কদমছাঁট না ববছাঁট, ওই যাকে বলে সেমি মাশরুমছাঁট ছেঁটে আমাদের লেডিস্ ক্লাবে ঢুকতেই সব হা হা করে তেড়ে এল।
- এ কি রে সুমি, তোর চুলগুলো এভাবে খামচে কে তুলে নিল? ঊষা উদাত্ত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল।
- দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে কল্পতরুর কাছে দাঁড়িয়ে কলা খেতে গেছল বোধ হয়, পিনপিন করে স্বপ্না সঙ্গ দিল।
- না রে না, ও বোধ হয় পাকা চুলগুলো বেছে ফেলে দিয়ে কচি সাজছে, ঊর্মি উবাচ।
- সাজছে তো সাজছে, তোর কি? তুই যে আধপাকা চুলগুলো বার্গান্ডি কালার করে জোকার সাজছিস তাতে সুমি কিছু বলেছে? খালি ওর পোকায় ধরা তরমুজের মত দাঁতগুলো বার করে হেসেছে, তা তুইও তাই কর না বাপু, পিন দিচ্ছিস কেন?
মিমিদির কথায় খুশি হব না রাগ করব বুঝতে না বুঝতেই আমাদের লেডিস ক্লাবের মধ্যমনি গীতাদির বাঁজখাই গলা অদৃশ্য থেকে বেজে উঠল।
-পিনের কথা কি যেন হচ্ছিল? কে কাকে পিন দিচ্ছে রে মিমি? কার পিন এত সস্তা হয়েছে শুনি? তা আলপিন, সেফটিপিন, হেয়ারপিন, তারপিন, কোন পিন এত মুফতে দিচ্ছিস রে? বলতে বলতে গীতাদি ধিরে সুস্থে ঘরে ঢুকে ওর মৌরসিপাট্টার ইজিচেয়ারটায় বেশ জুত হয়ে বসল।
আমি পিনপিন স্বরে ব্যাপারটা ব্যাখান করতে না করতেই মিমিদি মুখঝামটা দিয়ে বলল
- আমার পিন কোড সাত লক্ষ ছাপ্পান্ন গো গীতাদি, পিনের তো আর অভাব নেই যে দুএকটা খরচা করলে হুলুস্থুলু পড়ে যাবে।
- হুম তা তো বটেই, তবে সেই সঙ্গে আর একটা সমস্যা যে হবে সেটা কি ভেবেছিস হতভাগী?
- কি সমস্যা?
- ওই তোদের কোলকাতা ৫৬ থেকে কোলকাতা ৫৫ বা ৫৪ বা আরও কিছু হলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাসা বাড়ি চেঞ্জ করা, তোর যাতায়াতের সমস্যা, ইত্যাদি...এগুলোর কি হবে ভেবেছিস? তার ওপর তোর বর যদি ওই কোলকাতা ৫৬-র বসত বাড়ি, কি তোর শাশুড়িকে ছেড়ে তোর সাথে যেতেটেতে না চায়, তো সে আরেক সমস্যা। অতএব পিন খরচের আগে নিজের ঘর সামলে নিস।
গীতাদির ব্যাখান শুনে আমরা হেসে কূল পাই নে, আর মিমিদির মুখখানি বেশ শীতকালের বেগুনের মত ফুলে গেল। বেশ হয়েছে, খালি আমার পেছনে লাগা, না? মনে মনে গীতাদিকে বেশ বড়সড় থ্যাংকস না জানিয়ে পারলাম না।
যাই হোক, মিমিদি হল কি না ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট, চেহারাটা ঠিক বিহারী ভইসের মত কিনা,খালি বর্ণটি ধলা,এই যা। ও কিন্তু বেশ রেস্পন্সিবিলিটি নিয়ে দ্বায়িত্ব সামাল দেয়, অতএব হাওয়ার মোড় ঘুরে যাচ্ছে বুঝে চট করে নিজেও ঘুরে গেল।
- ও গীতাদি, রাখো ওই সব ছেঁদো কথা, তোমার ভাইপোর বিয়ে দেবে যে, পছন্দ মত মেয়ে খুঁজে পেলে?
লম্বা শ্বাস ফেলে বেশ একটা মন কেমন করা জর্দা মৌরীর সুগন্ধ ছড়িয়ে গীতাদি কেমন মুষড়ানো গলায় বলল
- না রে, যা চাই তা পাই না, আর যা পাই তা চাই না।
এতক্ষন পরে পরচর্চার বেশ রসালো বিষয় পেয়ে চনমনে হয়ে আমি নাক গলালাম,
- তা গীতাদি,কেমন মেয়ে চাই গো?
- মেয়েটা বেশ ফাটাফাটি রকমের সুন্দরী হবে, যাতে বউ নিয়ে বেরলে আশেপাশের লোকের চোখ টাটায়। টুকুন মানে আমার ভাইপোরও আবার বেশ ফরসা সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করার খুব ইচ্ছে।
আমি বললাম- বেশ, আর কী চাই?
- মেয়েটাকে বেশ ভদ্র হতে হবে, কিছুটা সংসারী, বেশ গোছানো স্বভাবের, মানে আমাদের টুকুনের ঠিক উল্টো, আবার টুকুনের মত শান্তশিষ্ট হবে না, বেশ দুষ্টু-মিষ্টি মেয়ে হবে। আমাদের ফ্যামিলির সাথে মানিয়ে নেবে এমন। কাজ পারুক বা না পারুক, তাতে সমস্যা নেই, আমি কাজ চালানো গোছের শিখিয়েই দেব। বেশি পাশটাশ না হলেও চলবে। আর সে রকম সেরকম মার্কামারা সুন্দরী হলে লাল পাড় শাড়ি আর দু’গাছা শাঁখা-পলা ছাড়া মেয়ের সাথে আর কিছু চাইও না।
- গীতাদি, আমি বলি কি, একবার কৃষ্ণনগরের দিকে গেলে হয় না? ওখানে অর্ডার দিলে যদি...
আমাদের ক্লাবের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী, সবার চেয়ে বিদুষী আর সব থেকে ছোট শর্মির ফুটনোট অ্যাড হল।
বহতী জলধারার মত কথার তোড়ে বাঁধা পেয়ে গীতাদি খানিকটা গুম খেয়ে শর্মির দিকে তাকিয়ে বলল
- বুঝলি শর্মি, মেয়েটা আসলে তোর মত হতে হবে। আমি যা যা বলছিলাম, তার সবই তোর মধ্যে আছে। শুধু তোর চেয়ে বয়সে একটু ছোট হতে হবে, বয়সের গ্যাপটা জরুরী।
শর্মি ঝরঝরিয়ে হেসে ফেলল। হাসলে রবি ঠাকুরের কৃষ্ণকলির মত কালো মেয়েটাকে এত মিষ্টি লাগে যে আমার তো সবসময় ওকে সুকুমার রায়ের আহ্লাদিনি সাজিয়ে রাখতে মন চায়।
আমার দিকে অপাঙ্গে চোখ টিপে শর্মি বলল- আমার মত হলে তো হবে না...
- কেন? কী সমস্যা?
গীতাদির চোখ দুটো পাঁচ টাকার রসগোল্লার মত গুল্লুস হয়ে উঠল
আমরা অবাক, বলে কী মেয়েটা?
- আমি তো ফাটাফাটি দেখতে নই, তোমার একদম প্রথম চাওয়াই তো মিললো না গো!! তারপরে তোমার সেকেন্ড রিকোয়ারমেন্ট ছিল ফর্সা, আমাকে তো আমার মাও সাহস করে শ্যামলী বলে না গো, কালো মেয়েই বলে। এই তো আজই আমার ভাইঝি বলেছে “কয়লা ধুলে ময়লা যেতে পারে, কিন্তু ছোটপিপি তোকে দুধের নদীতে চান করালে নদীটা কালো হয়ে যাবে, কিন্তু তুই একই থাকবি।”
আমরা সবাই এহেন সত্য কথনে হকচকিয়ে গেলেও গীতাদি কিন্তু খুব স্বাভাবিক গলায় বলল
- সত্যি রে শর্মি, আমি না বোকার মত এতক্ষণ তোর গুণগুলো ভাবছিলাম, তোর ঐ কালোকোলা মা কালী মার্কা চেহারার ব্যাপারটা একদমই ভাবি নি। টুকুনের বউ হিসাবে আমার কল্পনায় বেশ ফর্সা, সুন্দর দেখতে একটা মেয়েই আসছে, বুঝলি। তবে হাঁ, তোর মত গুণী মেয়ে হলে পটলচেরা চোখ টিকালো নাক না হোক, ফর্সা, পুতুল পুতুল গোছের সুন্দর মেয়ে হলেও চলবে।
ছোটবেলা থেকে আমরা শিখে গেছি কালো মানে খারাপ। যেকোনো খারাপ কিছুই কালো, আর ভালো মানে সাদা। অসৎ ব্যবসায়ী হল কালোবাজারি, অন্যায় পথে উপার্জিত অর্থ হল কালোটাকা। নোংরা কাজ করে পরিচয় হল কালোমুখ, আর অশুভ সময় কালবেলা। এভাবেই কালো গায়ের রং মানে কুৎসিত মানুষ হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ বুঝলাম আমার, আমাদের ভাবাটা কতটা ভুল। আমি নিজেকে খুব স্পেশাল ভাবি না। কিন্তু আজ বুঝলাম শুধু গায়ের চামড়া ফর্সা হবার দৌলতে আমি-মিমিদি-গীতাদি সবাই শিল্পচর্চায়,সাহিত্য মনস্কতায়, বিদ্যাবুদ্ধিতে এমনকি টাকা রোজগারের মাপকাঠিতেও শর্মির থেকে অনেক খাটো হয়েও কেবল মাত্র সুন্দরী হবার মাপকাঠিতে ওর থেকে অনেকটা এগিয়ে। পহেলে দর্শনধারী, পিছে গুণবিচারী। গীতাদি হয়তো কিছু ভেবে বলে নি, অনেকদিন থেকে চিনি তো ওনাকে। কিন্তু কথাটা চাবুকের মত এসে বাজলো আমার কানে। বলছিলাম বটে যে আমার খুব কম মন খারাপ হয়, কিন্তু এখন সত্যি সত্যি আমার মনটা খুব খারাপ।।
আমার খুব মন খারাপ হয়। সহজেই মন ভালো করে ফেলি, কিম্বা হুঠহাট কাঁদতে পারি, তাই বেশিক্ষণ মন খারাপ থাকে না। সেই আমারও কদিন থেকে মন খারাপ, কারণটা আর কিছুই নয়, মাথার চুল। এমনিতেই চুলে পাক ধরেছে, তার ওপর ভুসভুস করে রোজ চিরুনি ভরে চুল উঠছে। ভয়ের চোটে চুল আঁচড়ানো প্রায় ছেড়ে দিলে কি হবে, চুল উঠতে উঠতে ব্যাপারটা প্রায় “স্মৃতিটুকু থাক”-এর পর্যায়ে চলে গেছে। ক’দিন পরে রাস্তায় প্যাঁক খেতে হবে “নেড়ি যায় বেলতলায়।” অতএব সাত পাঁচ ভেবে মেয়ের প্ররোচনায় বেশ না কদমছাঁট না ববছাঁট, ওই যাকে বলে সেমি মাশরুমছাঁট ছেঁটে আমাদের লেডিস্ ক্লাবে ঢুকতেই সব হা হা করে তেড়ে এল।
- এ কি রে সুমি, তোর চুলগুলো এভাবে খামচে কে তুলে নিল? ঊষা উদাত্ত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল।
- দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে কল্পতরুর কাছে দাঁড়িয়ে কলা খেতে গেছল বোধ হয়, পিনপিন করে স্বপ্না সঙ্গ দিল।
- না রে না, ও বোধ হয় পাকা চুলগুলো বেছে ফেলে দিয়ে কচি সাজছে, ঊর্মি উবাচ।
- সাজছে তো সাজছে, তোর কি? তুই যে আধপাকা চুলগুলো বার্গান্ডি কালার করে জোকার সাজছিস তাতে সুমি কিছু বলেছে? খালি ওর পোকায় ধরা তরমুজের মত দাঁতগুলো বার করে হেসেছে, তা তুইও তাই কর না বাপু, পিন দিচ্ছিস কেন?
মিমিদির কথায় খুশি হব না রাগ করব বুঝতে না বুঝতেই আমাদের লেডিস ক্লাবের মধ্যমনি গীতাদির বাঁজখাই গলা অদৃশ্য থেকে বেজে উঠল।
-পিনের কথা কি যেন হচ্ছিল? কে কাকে পিন দিচ্ছে রে মিমি? কার পিন এত সস্তা হয়েছে শুনি? তা আলপিন, সেফটিপিন, হেয়ারপিন, তারপিন, কোন পিন এত মুফতে দিচ্ছিস রে? বলতে বলতে গীতাদি ধিরে সুস্থে ঘরে ঢুকে ওর মৌরসিপাট্টার ইজিচেয়ারটায় বেশ জুত হয়ে বসল।
আমি পিনপিন স্বরে ব্যাপারটা ব্যাখান করতে না করতেই মিমিদি মুখঝামটা দিয়ে বলল
- আমার পিন কোড সাত লক্ষ ছাপ্পান্ন গো গীতাদি, পিনের তো আর অভাব নেই যে দুএকটা খরচা করলে হুলুস্থুলু পড়ে যাবে।
- হুম তা তো বটেই, তবে সেই সঙ্গে আর একটা সমস্যা যে হবে সেটা কি ভেবেছিস হতভাগী?
- কি সমস্যা?
- ওই তোদের কোলকাতা ৫৬ থেকে কোলকাতা ৫৫ বা ৫৪ বা আরও কিছু হলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাসা বাড়ি চেঞ্জ করা, তোর যাতায়াতের সমস্যা, ইত্যাদি...এগুলোর কি হবে ভেবেছিস? তার ওপর তোর বর যদি ওই কোলকাতা ৫৬-র বসত বাড়ি, কি তোর শাশুড়িকে ছেড়ে তোর সাথে যেতেটেতে না চায়, তো সে আরেক সমস্যা। অতএব পিন খরচের আগে নিজের ঘর সামলে নিস।
গীতাদির ব্যাখান শুনে আমরা হেসে কূল পাই নে, আর মিমিদির মুখখানি বেশ শীতকালের বেগুনের মত ফুলে গেল। বেশ হয়েছে, খালি আমার পেছনে লাগা, না? মনে মনে গীতাদিকে বেশ বড়সড় থ্যাংকস না জানিয়ে পারলাম না।
যাই হোক, মিমিদি হল কি না ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট, চেহারাটা ঠিক বিহারী ভইসের মত কিনা,খালি বর্ণটি ধলা,এই যা। ও কিন্তু বেশ রেস্পন্সিবিলিটি নিয়ে দ্বায়িত্ব সামাল দেয়, অতএব হাওয়ার মোড় ঘুরে যাচ্ছে বুঝে চট করে নিজেও ঘুরে গেল।
- ও গীতাদি, রাখো ওই সব ছেঁদো কথা, তোমার ভাইপোর বিয়ে দেবে যে, পছন্দ মত মেয়ে খুঁজে পেলে?
লম্বা শ্বাস ফেলে বেশ একটা মন কেমন করা জর্দা মৌরীর সুগন্ধ ছড়িয়ে গীতাদি কেমন মুষড়ানো গলায় বলল
- না রে, যা চাই তা পাই না, আর যা পাই তা চাই না।
এতক্ষন পরে পরচর্চার বেশ রসালো বিষয় পেয়ে চনমনে হয়ে আমি নাক গলালাম,
- তা গীতাদি,কেমন মেয়ে চাই গো?
- মেয়েটা বেশ ফাটাফাটি রকমের সুন্দরী হবে, যাতে বউ নিয়ে বেরলে আশেপাশের লোকের চোখ টাটায়। টুকুন মানে আমার ভাইপোরও আবার বেশ ফরসা সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করার খুব ইচ্ছে।
আমি বললাম- বেশ, আর কী চাই?
- মেয়েটাকে বেশ ভদ্র হতে হবে, কিছুটা সংসারী, বেশ গোছানো স্বভাবের, মানে আমাদের টুকুনের ঠিক উল্টো, আবার টুকুনের মত শান্তশিষ্ট হবে না, বেশ দুষ্টু-মিষ্টি মেয়ে হবে। আমাদের ফ্যামিলির সাথে মানিয়ে নেবে এমন। কাজ পারুক বা না পারুক, তাতে সমস্যা নেই, আমি কাজ চালানো গোছের শিখিয়েই দেব। বেশি পাশটাশ না হলেও চলবে। আর সে রকম সেরকম মার্কামারা সুন্দরী হলে লাল পাড় শাড়ি আর দু’গাছা শাঁখা-পলা ছাড়া মেয়ের সাথে আর কিছু চাইও না।
- গীতাদি, আমি বলি কি, একবার কৃষ্ণনগরের দিকে গেলে হয় না? ওখানে অর্ডার দিলে যদি...
আমাদের ক্লাবের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী, সবার চেয়ে বিদুষী আর সব থেকে ছোট শর্মির ফুটনোট অ্যাড হল।
বহতী জলধারার মত কথার তোড়ে বাঁধা পেয়ে গীতাদি খানিকটা গুম খেয়ে শর্মির দিকে তাকিয়ে বলল
- বুঝলি শর্মি, মেয়েটা আসলে তোর মত হতে হবে। আমি যা যা বলছিলাম, তার সবই তোর মধ্যে আছে। শুধু তোর চেয়ে বয়সে একটু ছোট হতে হবে, বয়সের গ্যাপটা জরুরী।
শর্মি ঝরঝরিয়ে হেসে ফেলল। হাসলে রবি ঠাকুরের কৃষ্ণকলির মত কালো মেয়েটাকে এত মিষ্টি লাগে যে আমার তো সবসময় ওকে সুকুমার রায়ের আহ্লাদিনি সাজিয়ে রাখতে মন চায়।
আমার দিকে অপাঙ্গে চোখ টিপে শর্মি বলল- আমার মত হলে তো হবে না...
- কেন? কী সমস্যা?
গীতাদির চোখ দুটো পাঁচ টাকার রসগোল্লার মত গুল্লুস হয়ে উঠল
আমরা অবাক, বলে কী মেয়েটা?
- আমি তো ফাটাফাটি দেখতে নই, তোমার একদম প্রথম চাওয়াই তো মিললো না গো!! তারপরে তোমার সেকেন্ড রিকোয়ারমেন্ট ছিল ফর্সা, আমাকে তো আমার মাও সাহস করে শ্যামলী বলে না গো, কালো মেয়েই বলে। এই তো আজই আমার ভাইঝি বলেছে “কয়লা ধুলে ময়লা যেতে পারে, কিন্তু ছোটপিপি তোকে দুধের নদীতে চান করালে নদীটা কালো হয়ে যাবে, কিন্তু তুই একই থাকবি।”
আমরা সবাই এহেন সত্য কথনে হকচকিয়ে গেলেও গীতাদি কিন্তু খুব স্বাভাবিক গলায় বলল
- সত্যি রে শর্মি, আমি না বোকার মত এতক্ষণ তোর গুণগুলো ভাবছিলাম, তোর ঐ কালোকোলা মা কালী মার্কা চেহারার ব্যাপারটা একদমই ভাবি নি। টুকুনের বউ হিসাবে আমার কল্পনায় বেশ ফর্সা, সুন্দর দেখতে একটা মেয়েই আসছে, বুঝলি। তবে হাঁ, তোর মত গুণী মেয়ে হলে পটলচেরা চোখ টিকালো নাক না হোক, ফর্সা, পুতুল পুতুল গোছের সুন্দর মেয়ে হলেও চলবে।
ছোটবেলা থেকে আমরা শিখে গেছি কালো মানে খারাপ। যেকোনো খারাপ কিছুই কালো, আর ভালো মানে সাদা। অসৎ ব্যবসায়ী হল কালোবাজারি, অন্যায় পথে উপার্জিত অর্থ হল কালোটাকা। নোংরা কাজ করে পরিচয় হল কালোমুখ, আর অশুভ সময় কালবেলা। এভাবেই কালো গায়ের রং মানে কুৎসিত মানুষ হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ বুঝলাম আমার, আমাদের ভাবাটা কতটা ভুল। আমি নিজেকে খুব স্পেশাল ভাবি না। কিন্তু আজ বুঝলাম শুধু গায়ের চামড়া ফর্সা হবার দৌলতে আমি-মিমিদি-গীতাদি সবাই শিল্পচর্চায়,সাহিত্য মনস্কতায়, বিদ্যাবুদ্ধিতে এমনকি টাকা রোজগারের মাপকাঠিতেও শর্মির থেকে অনেক খাটো হয়েও কেবল মাত্র সুন্দরী হবার মাপকাঠিতে ওর থেকে অনেকটা এগিয়ে। পহেলে দর্শনধারী, পিছে গুণবিচারী। গীতাদি হয়তো কিছু ভেবে বলে নি, অনেকদিন থেকে চিনি তো ওনাকে। কিন্তু কথাটা চাবুকের মত এসে বাজলো আমার কানে। বলছিলাম বটে যে আমার খুব কম মন খারাপ হয়, কিন্তু এখন সত্যি সত্যি আমার মনটা খুব খারাপ।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন