কবিতার পরিবারের একমাত্র ব্লগজিন

এখনও পর্যন্ত  Website counter  জন ব্লগটি দেখেছেন।

শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৩

গল্প - শ্রীশুভ্র ভট্টাচার্য

ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন
শ্রীশুভ্র ভট্টাচার্য


অরুণ যে আমার বিশেষ নিকট বন্ধু তা নয়! তবে একেবারেই আলগা বন্ধুত্বও নয়! তাই ওর বিবাহে বরযাত্রীর যাওয়ার নিমন্ত্রণ না পেলেও বৌভাতে যাবার অনুরোধ এড়াতে পারিনি! কিন্তু মুশকিল হল কি দেওয়া যায় উপহার হিসেবে? যেটাই ভাবি সেটাই বড়ো খেলো মনে হয়! সাধারণ কেরানীপকেটের চৌহদ্দীতে যা হয় আর কি! যদিও উপহার যা দেব তা দেব ঐ অরুণের বৌকেই! পাক্কা ব্যবসায়ী অরুণ সামান্য তুচ্ছ উপহার নিয়ে মাথা ঘামাবে না জানি তবু ন্যূনতম ভদ্রতা রক্ষার দায় তো থাকেই! যদিও জানি অরুণের সাথে ওর ব্যবসায়ে লাভজনক কোনো বড়ো পার্টির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে খুশি করা যেত ওকে! কিন্তু আমি ছাপোষা মানুষ, আদার ব্যাপারীও নই! এটা তেমন উপলক্ষও নয়!

তবে সুকন্যা থাকলে আজ আমায় এত ভাবতে হতো না! কোথায় কোনটা মানানসইসেটা বুঝবার একটা দারুণ ক্ষমতা ছিল ওর! রুচিশীল একটা মনের তন্বী মেয়ে! ডানাকাটা পরী নয়, কিন্তু অপরূপ একটা দ্যুতি ছিল টানা দুটি চোখে! দৃষ্টির সেই গভীরতায় ছিল আত্ম প্রত্যয়ের দীপ্তি! আর ছিল কাব্য প্রীতি! নিজে লিখত না! কিন্তু ভালো কবিতার কদর জানতো! ইউনিভার্সিটির তুখর ছাত্রী! ইংরেজী সাহিত্যের বর্ষসেরা! সাহিত্য আমার বিষয় নয়! তবু সুকন্যাই আমাকে সুসাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়! সেই থেকে আমারও কবিতা প্রীতি! সুকন্যা প্রেম! কবিতার মধ্যেই শ্বাস নিত যেন মনে হতো! আস্তে আস্তে আমাকেও ডোবালো ওতেই!
ব্রাউনিঙের কবিতা ছিল ওর খুব প্রিয়! খুব আবৃত্তি করতো!

সুকন্যার আবৃত্তি যে খুব উচ্চমানের ছিল তা হয়তো নয়! কিন্তু ওর মুখচোখের দীপ্তি বলার ছন্দ মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো আমায়! তার কারণ যতটা কাব্য প্রেম ততটাই ওর প্রতি আমার দূর্বলতা! এই ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালী দিনগুলোও একদিন স্মৃতির সরণীতে ঢুকে গেল! জীবিকার সন্ধানে কে কোথায় ছিটকে গেলাম! সুকন্যাও উচ্চতর বিদ্যার্জনের জন্য বাইরে চলে গেল! কিন্তু গেলেও যোগাযোগ যে রাখা যেত না তা হয়তো নয়! হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন সুকন্যা আর আমার মতো সাধারণ মানুষের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করেনি বলেই ধীরে ধীরে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল আরও! ব্যাপারটা এতই স্বাভাবিক ছন্দে ঘটে গিয়েছিল যে বুঝতেই পারিনি কখন সুকন্যা সরে গেছে দূরে!

বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি এভাবেই মানুষের জীবনে কতো সহজেই যেন স্মৃতি হয়ে যায় একদিন! রোজকার বন্ধুদের, যাদের ছাড়া একদিনও চলে না, কালের গতিতে তারাও কোথায় হারিয়ে যায়! কিন্তু সুকন্যা! সেতো শুধুই বন্ধু ছিল না! তাকে ঘিরে ভবিষ্যৎ জীবনের সপ্নাভ আশার বিস্তার ছিল প্রতিদিনের শাখা প্রশাখায়! তবু সেও তো দূরে সড়িয়ে নিল নিজেকে! তবু এত দিন পরে আজ তাকেই মনে পড়ছে বড়ো বেশি করে! এই আগোছালো জীবন হয়ত আর আগোছালো থাকতনা! সামান্য একটা উপহার নির্বচন করতে কি বেহাল দশা আজ! এই সবই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল ওকে বলেছিলাম ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন উপহার দেব ওর জন্মদিনে! মহালয়ার দিন! দেবীপক্ষের সূচনায়! কিন্তু সে আর দেওয়া হল কই!

সত্যি সুকন্যাকে উপহারটা আর দেওয়ার সুযোগ ঘটেনি! এতদিন পর সেকথা মনে হতেই মনটা বড়ো বিষন্ন হয়ে গেল! মনে পড়ে গেল ব্রাউনিঙের দ্য লাস্ট রাইড টুগেদারের কথা! সুকন্যার আবৃত্তির সাথে আমিও গলা মেলাতাম কখনো সখনো! আসলে ব্রাউনিঙের মধ্যে যে দুরন্ত প্যাশানের সুতীব্র প্রকাশ ছিল, সেটা আমাদের উন্মন করে তুলত প্রথম যৌবনের তরুণ দিনে! হঠাৎ মনে হল, অরুণের বৌভাতে ব্রাউনিঙের সংকলন দিলে কেমন হয়? যদিও অরুণের জীবনে প্রফিট এণ্ড লসের ব্যালেন্স শীট ছাড়া অন্য কোনো কাগজের গুরত্ব নেই বিশেষ! তবে ওর বৌ হয়তো সাহিত্যপ্রেমী হতেও পারে! ওদের নবজীবনের শুভারম্ভ ব্রাউনিঙের রোমান্টিকতায় ভরপুর হয়ে উঠুক না কেন দাম্পত্যের প্রতিদিনের বাসরে!

অরুণদের পয়সা বুঝি মেঝেতে গড়াগড়ি যায়! এমন এলাহী ব্যাপার আগে কোনো বৌভাতে দেখিনি কখনো! গেটের সামনে দেশী বিদেশী কত রঙের ছোট বড়ো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে! আমন্ত্রীতদের পয়সার আভিজত্য পোশাকের গন্ধেই স্পষ্ট বোঝা যায়! এই রকম ধনদৌলতের ঐশ্বের্য্যের মাঝে নিজের কেরাণী গন্ধওয়ালা অস্তিত্বটা নিয়ে, একটা ব্রাউনিঙের কবিতার বই সম্বল করে ঢুকতে বড়ই সঙ্কোচ হচ্ছিল! নিজেকে এত অসহায় মনে হচ্ছিল যে ভাবছিলাম ফিরে যাব কিনা! অন্তত আসার জন্য বড়ই মর্মপীড়া অনুভব করছিলাম!

অরুণ বোধহয় কাউকে খুঁজতে বেড়িয়ে ছিল! আমায় দেখতে পেয়েই সহাস্যে এগিয়ে এলো! সাথে নিয়ে ভেতরে গেল! কিন্তু আমার সাথে কথা বলার অবসর নেই! আমায় বসিয়ে আবার কার সাথে চলে গেল বাইরে! আমি একা জড়সড় বসে হয়ে চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছিল্লাম! এই ধনৈশ্বর্য্যের বৈভবের মাঝে নিজেকে খুবই অপাঙতেয় লাগছিল! বেশ অনেক্ষণ পরেই অরুণের আবার আমার ওপর নজর পড়ল! আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! নিজের অস্বস্তিতে বেশ হাঁফিয়ে উঠছিলাম! অরুণ নিজেই আমায় নিয়ে দোতলায় উঠল! নববধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে! আমাকেও উপহারটা দিতে হবে! নববধুকে ঘিরে স্বভাবতই অপরূপা মায়াবিনী সুন্দরীদের ভিড়! উৎসবের আনন্দে উৎসাহিত মুখগুলির কলধ্বনিতে মুখরিত পরিবেশ!

আগেও দেখেছি এইরকম বিবাহ অনুষ্ঠানে সাজসজ্জার ভিড়ে নববধুটি যে কে তা বুঝে উঠতে কয়েক সেকেণ্ড দেরি হয়ে যায়! নববধু হয়তো কারুর সাথে গল্পই করছিলেন! এইরকম বৈভবে উচ্চবিত্ত সমাজের সুসজ্জিত বেশভুষার ঝাঁচকচকে মানুষজনের মধ্যে আমি এতই বেমানান যে, সঙ্কোচ আর লজ্জা আমায় পীড়া দিতে থাকল! কিন্তু আসরে নেমে পড়েছি, আর ভাবা চলে না! মুখে একটা কৃত্রিম কষ্টকলপিত হাসি টেনে এগোলাম! এই অবস্থায় নিজেকে আয়নায় কেমন দেখাতো ভেবে সত্যিই হাসি পেল! সেই নিদারুণ হাসি মুখেই নববধুর নিকটবর্তী হলাম! অরুণ ওর বৌয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে উদ্যত হল! অরুণের ডাকে ওর নব পরিণীতা বধু আমাদের দিকে ফিরতেই মুখে হাসি ঝুলিয়ে উপহারটি দিতে হাত বাড়ালাম!

ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন! যে উপহার একদিন সুকন্যার জন্মদিনে ওর হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল, আজ অরুনের বৌভাতে সেইউপহার তার বৌয়ের হাতে তুলে দিতে এসেছি! অরুণের গর্বিত হাসির লহড়াতেই দৃষ্টিবিনিময় হল নববধুর সাথে! আর তখনই বেনারসী আর স্বর্ণালঙ্কারের সজ্জায় সুকন্যাকে দেখে চমকে ওঠার পালা আমারই! কিন্তু সুকন্যা ওর, আমায় চেনার চমকটাকে কি অদ্ভুত সহজভাবেই না মনভোলানো হাসিতে ঢেকে দিলো! আরও আশ্চর্য ওর ঐ অভিজাত হাসির উপরেই ভর করে আমিও কত সহজেই সামলে নিলাম নিজেকে! তুলে দিলাম ওরই হাতে আমার ক্ষুদ্র উপহার ওর প্রিয় ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন! যেখান থেকে একদিন আবৃত্তি করতাম আমরা দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন