কবিতার পরিবারের একমাত্র ব্লগজিন

এখনও পর্যন্ত  Website counter  জন ব্লগটি দেখেছেন।

মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩

ছোটগল্প - মেহেদী হাসান

উৎসব



শীতের বিষণ্ণ দুপুর- ভরপেট খেয়ে আরামের ঘুম দিয়েছে রাসেল। গলা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সমস্ত শরীর একটা পুরু কম্বলে ঢাকা। দরজা-জানালা সব এঁটে বন্ধ করে দেয়া-পুরো ঘর জুড়ে যেন কবরের ঘন নিস্তব্ধতা। রাসেল ঘুমের অতলে ভেসে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সুখ স্বপ্নে, স্বপ্ন প্রাঙ্গনের এক কোনায় হঠাৎ সে দেখতে পেল দুইজন লোক নিজেদের ভেতর কি একটা রহস্যজনক বিষয় নিয়ে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। তাদের এই ফিসফিস শব্দ শুনে কোথা থেকে যেন আরেকজন লোক এসে যোগ দিল। ফিসফিসানির শব্দ ধীরে ধীরে গুঞ্জনে পরিণত হতে থাকে। তারপর দুই দিক থেকে দুইজন, এপাশ থেকে তিনজন, ওপাশ থেকে আরো চারজন- এভাবে আস্তে আস্তে চতুর্দিক থেকে অনেক মানুষ এসে জড়ো হতে লাগল। মানুষের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউয়ের মত গর্জন করতে করতে দল বেঁধে আসছে সবাই। গুঞ্জন বাড়তে বাড়তে কোলাহলে পরিনত হয়ে স্বপ্নের ক্ষুদ্র সীমা অতিক্রম করে বৃহৎ বাস্তবের উঠানে এসে পড়ল।

রাসেলের মাথার মধ্যে ঝিমঝিম ভাব, আড়ষ্ট চোখের পাতা খুলতে কষ্ট হচ্ছে; শরীরটা যেন এখনও শুয়ে আছে ঘুমের বিছানাতেই। চতুর্দিক থেকে তীব্র কোলাহল, বিকট চিৎকার, ছোঁয়াচে চেঁচামেচি, হল্লা দিয়ে কান্না, বুক থাপড়ানো হাহাকার, অস্ফুট ধ্বনি, অস্পষ্ট বিভিন্ন ধরনের শব্দ তার কানের পর্দায় ঠাস ঠাস করে আঘাত করছে!

উঠান ভর্তি দিকভ্রান্ত মানুষ পাগলের মত এদিক সেদিক ছুটছে। প্রায় সবারই হাতে-পায়ে, মুখে, মাথার চুলে- শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পিচ্ছিল কাদা। অধিকাংশ পুরুষের লুঙ্গি মালকোছা মারা, মহিলাদের শাড়ীর আঁচল ঘাড়-বুক থেকে খসে গেছে অনেক আগেই, যাদের পরনে ব্লাউজ নেই, আথালি-পাথালি হাঁটাচলা ও দৌড়-ঝাপের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের ঝুলে পড়া স্তন জোড়ার লাফঝাঁপ দেখে অনেক ভদ্র লোকেরই বিবমিষা উদ্রেক করবে। ছিমছাম কয়েকটি ছাত্র ছোকরা জনতার দঙ্গল থেকে সাবধানে গা বাঁচিয়ে উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। গ্রামের মুরুব্বীদের অবাক চোখে চতুর্দিক নিরীক্ষণ করতে করতে মাথার চুল ধরে টানার দৃশ্য দেখেও বোঝার উপায় নেই ঘটনাটা আসলে কি! কিশোরী মেয়েদের চুলের খোপা খসে গিয়ে ঘড়ির পেন্ডুলামের মত এ ঘাড় থেকে ও ঘাড় পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ানোর সৌন্দর্য এরকম সময়েও অনেকেই মোহিত করবে বলেই মনে হয়। উঠানের সামনের দিক দিয়ে অবিরত ভাবে লোকজন বের হয়ে যেতে থাকলেও উঠানে কিন্তু মানুষের সংখ্যা কমার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না কারন চরাক্ষেত থেকে পুকুরের ধার দিয়ে দীর্ঘ মিছিলের লেজের মত লোকজন হাঁপাতে হাঁপাতে উঠোনে এসে যেন অনেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।

রাসেল যাকে হাতের কাছে পেল তাকেই জিজ্ঞেস করতে লাগল, কি অইছে আপনারা এমন করতাছেন ক্যা? দোহাই লাগে ঘটনাটা খুইলা কইন। আপনেগো ব্যাপার স্যাপার আমি কিছুই বুঝতাছিনা। আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, আমারে কইন কি অইছে, দেহি কি করন যায়; দয়া কইরা শান্ত অইন। অস্থির অইন না জানি, আমার ঘরে আইয়া বইয়া কইন ঘটনা কি অইছে। ঘটনাটা খুলে বলা তো দূরের কথা রাসেলের দিকে কেউ একটি বারের জন্য ভ্রুক্ষেপও করলনা। তার আত্মসন্মান বড় ধরনের একটি ঘা খেল, অহংকার মূর্ছিত হয়ে রইল কিছুক্ষণের জন্য। সে ক্রুদ্ধ হয়ে সামনের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো। ফুলে উঠা রাগ কোন দিক দিয়ে বের হবার সুযোগ না পেয়ে বুকের ভেতর গজগজ করতে থাকে।

কটি বয়স্কা নারী, হাঁপাতে হাঁপাতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল, এডা লুঙ্গি দেও বাবা; তাড়াতাড়ি এডা লুঙ্গি ঘর থিক্যা বাইর কইরা আনো। অর লুঙ্গির মধ্যে ক্যাদা নাইগা বোঝাই অইয়া গেছে গা। মহিলাটি রাসেলের দুঃসম্পর্কীয় আপা লাগলেও নির্দিদ্ধায় তাকে বাবা সম্বোধন করতে একটুও আটকালনা। এ রকম কোলাহলের মধ্যে কাউকে কোনকিছু দিলে তা ফেরত পাওয়ার আশা করা বোকামী। ঘরে তো কোন লুঙ্গি নাই, লুঙ্গি দিয়া কি অইব? আইচ্ছা ঘটনাটা কি অইছে আমারে খুইলা কইনছে। মহিলাটি শুধু বলতে পারলো, আমাগো শামীমেরে কারেন্টে ধরছে গো---কারেন্টে ধরছে। মরতাছে গো মরতাছে—কারেন্টে ধইরা মরতাছে! মহিলাটি আবার হাঁপাতে হাঁপাতে জনস্রোতের সাথে মিশে গিয়ে পাগলের মত দু হাত দিয়ে মানুষজন সরাতে সরাতে সামনের দিকে এগুতে লাগলো। রাসেলও সাথে সাথেই মহিলাটির পিছনে লাগালো এক ছুট। কিছুটা নিজের চেষ্টায় আর কিছুটা লোকজনের ধাক্কায় গ্রামের ভেতরের ছোট রাস্তাটি ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে অবশেষে নদীর ধার ঘেঁষে পাকা রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

মালকোছা মারা মোটাসোটা জোয়ান একজন অচেতন মানুষকে ভ্যানের উপর রেখে দশ-বারোজন লোক চতুর্দিকে ঘিরে ধরে ঘাড়ের নিচ থেকে শুরু করে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রত্যেকটি জায়গায় চোখ মুখের মধ্যে একধরনের সহানুভূতির ভাব জাগিয়ে রেখে বৃষ্টির ধারা-বর্ষণের মত কিল, ঘুষি, থাপ্পড় এমনকি মাঝে মাঝে পা উপরে তুলে লাথি পর্যন্ত মেরে চলছে। মারতে মারতে তারা অনেকেই প্রচন্ড রকমের ক্লান্ত, শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে। বালক বয়সের ছেলেরা যারা শরীরের বিভিন্ন জায়গার মাংশ পেশী টিপে দিচ্ছিল তাদের অনেকেরই চোখে মুখে হঠাৎ হঠাৎ দু একটা কিল থাপ্পর এসে লাগতেই তারা কিছুটা খেকিয়ে উঠে আবার শরীর টিপতে শুরু করে দেয়। এই অবিরত কিল, ঘুষি, থাপ্পর, লাত্থির চোটে নাকি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট লোকটির শরীরের জমাট বাঁধা রক্ত চলাচল করতে শুরু করবে। তাতে করে লোকটি হয়তো বেঁচেও উঠতে পারে!

শামীমের উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ কালো কুচকুচে হয়ে গেছে, বুকের বাম পাশে একটি নাতিদীর্ঘ সদ্যপোড়া দাগ, মুখটি ভাবলেশহীন, বাঁ-হাতটি শরীরের একপাশে নিথর হয়ে পড়ে আছে। ডানহাতটি শিথিল ভাবে মুঠ করা, আঙ্গুলগুলো কুকড়ে কিছুটা বাঁকা হয়ে গেছে। ধরেই সাথে সাথে ছেড়ে দেওয়ার একটি চেষ্টার ছবি আঙ্গুল কয়েকটির মধ্যে এখনও অনেকটা স্পষ্ট। ঠোঁটের বাম পাশের কোনা দিয়ে বের হওয়া গ্যাঁজলা দেখে মেয়েরা মুখে কাপড় চাপা দেয়। চোখের পাতা দুটি হাট করে খোলা, ঘোলা চোখে বাঁচার আকুতিটিও যেন ইতিমধ্যে মরে গেছে।

ইলেকট্রিসিটির তার দিয়ে নগর জীবনের অনেক বিষয়ই গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়েছে আজকাল। অজ পাড়া গ্রামগুলোতেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাব বেড়ে যাচ্ছে অপ্রতিহত ভাবে। রাষ্ট্র এখন সমাজের বেড়া ডিঙ্গিয়ে মানুষের ঘরের ভেতরটা পর্যন্ত নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখতে চায়। রেজিষ্টার্ড ডাক্তার কতৃক মৃত ঘোষিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ সাহস করে বলতেই পারলোনা, মৃত মানুষটিকে কেন শুধু শুধু টানা হেঁচড়া করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছো?

শামীমের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাবার পর টানা তিন দিন ধরে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় টানা বর্ষনের মত আলোচনা চলতে লাগল। পুরো গ্রামটি যেন তিনদিনধরে শামীমের মৃত্যু ঘটনার উপর ধলি বকের মত একপায়ে দাঁড়িয়ে শোকের পুঁটিমাছ খুটে খুটে খেতে থাকে। চরা ক্ষেতে আলের ধারে, পেকা জমিতে গোছা গাড়ার সময়, নদীর পাড়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে, সকালে দুপুরে রাত্রে খাবার খেতে খেতে এমনকি প্রেমিক-প্রেমিকার নিভৃত দেখা সাক্ষাতের সময়ও একই আলোচনা। স্বামী-স্ত্রী গভীর রাতে তাদের নিজস্ব উত্তেজনার সময়, উত্তেজনা শেষে রণক্লান্ত অবস্থায় দুইদিকে মুখ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তেও শামীমের কালো হয়ে যাওয়া মুখটা স্মরনে আনে। তখন তাদের বুকের ভেতরে কি যেন একটা ইস্ক্রুপের মত মোচড় দিয়ে কলিজার ভেতর ঘচ করে ঢুকে পড়ে। পাড়াবেড়ানী বয়স্কা নারীরা তো এই ঘটনা আচলের খুঁটে বেঁধে শরীরে নতুন উদ্যমের গন্ধ মেখে বাড়ীর পর বাড়ী হেঁটে বেড়ায়। ছাত্র ছোকরারা সাইকেলে চড়ে স্কুল কলেজে যাওয়ার সময় শামীমের বিষয়ে আলোচনায় মনোযোগী হয়ে এবড়োথ্যাবড়ো পাকা রাস্তায় হঠাৎ উল্টে পড়ে। কিশোরী মেয়েরা উঠোনের মাঝখানে দাগ দিয়ে এক্কাদোক্কা খেলার মাঝখানে শামীমের চটুল টিটকিরির কথা মনে করে দম ভুলে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। তাসের আড্ডায় তাস বাটা ভুলে গিয়ে চলতে থাকে তাস খেলায় শামীমের অপটু বিষয়ে আলোচনা। মদ খাওয়ার অভ্যাস যাদের একটু- আধটু আছে তারা শোকে কাতর হয়ে গড়ের ভেতর গারো পাড়ায় বাংলা মদের আসর জমায়, তাতে করে শীতের রাত্রে এদের শরীরও একটু গরম হয়। শামীমের স্মৃতিকে স্মরন করে মদের গ্লাশ ঠোটে ছোঁয়ানোর সময় মাতাল হওয়ার বদলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে অনেকেই। শীতের রাত্রে বদ্ধ ঘরে আমেজ করে বসা জুয়ার আসরে টাকার লেনদেনের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে নীরসমুখে শামীমের সাথে ঘটে যাওয়া খন্ড ঘটনাগুলো আলোচনা করতে থাকে গ্রামের সব পাকা-পাকা জুয়াড়িরা।

শোকের সময় ঢিমেতালে গড়িয়ে গড়িয়ে বয়ে যেতে থাকে। শামীমের এই মৃত্যু শোক মানুষের কাজে-চলাফেরায় তেমন কোন ব্যাঘাত ঘটায় বলে মনে হয় না। এবং কখনো সখনো শুধু আড্ডার আমেজই বাড়িয়ে চলে। শোক মানুষের চতুর্দিকে হালকা ধোঁয়ার কুন্ডলীর মত ঘিরে থাকে, শুধু বয়ে চলার সাথে মেপে মেপে খানিকটা করে উড়ে যেতে দেখা যায়।

ঠান্ডা আমেজের বিকেল বেলায় শামীমের জানাজা শেষ করে জাহিদ চা স্টলে আসলে- ছোটরা তার বসার জন্য বেঞ্চের খানিকটা জায়গা খালি করে দেয়। এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে দিয়ে কিছুটা কুঁজো হয়ে জাহিদ বসে পড়ে আস্তে করে। চা স্টলে ইতিমধ্যেই জানাজা শেষ করে ছোট বড় অনেকেই ভিড় জমিয়েছে- তাদের প্রায় সবার মাথাতেই জানাজার সময় পড়া টুপিটি এখনো আছে। শুধু মাত্র জাহিদই জানাজা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সার্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। অনেক ক্ষণ বিষণ্ণ থাকতে থাকতে টুপি মাথায় দেওয়া সবাই মোটামুটি ক্লান্ত। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে, সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বিষন্নতাকে মাটি চাপা দিতেই সবাই এই ছোট চা স্টলটিতে এসে হাজির হয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই চা স্টলের ছোট পরিসরটি হা হুতাশ আর দীর্ঘশ্বাসে জমজমাট হয়ে উঠে। আর জাহিদের বুকের ভেতর থরে থরে সাজানো ক্ষোভ-এই শোকাবহ পরিবেশে বের হওয়ার জায়গা না পেয়ে বুকের ভেতরে আকুলি বিকুলি করতে শুরু করে। সে এককাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে আর একটি সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টানতে থাকে। গ্রামে বড়দের সামনে সিগারেট খাওয়া ঘোরতর বেয়াদবী জেনেও রাশি রাশি ধোঁয়া উঠে জাহিদের মুখ থেকে যেন ইট ভাটার বিশাল বিশাল লম্বা চোঙ্গ থেকে সাদা সাদা ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়া নয় যেন পুঞ্জ পুঞ্জ ক্ষোভের গলিত বাষ্প। বড়দের সামনে সিগারেট খাওয়াটাকে সে এখন আর বেয়াদবীও মনে করেনা। কিন্তু জাহিদ লক্ষ্য করে, অনেকেই তার দিকে যেন একটু কেমন কেমন করে তাকাচ্ছে। জাহিদ শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, শীতের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। গ্রামের লোকজন কানাঘুষা করে জাহিদ সেখানে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছে-সে নাকি আর মুসলমান নেই কম্যুনিষ্ট হয়ে গেছে। আল্লাহ-খোদায় তার নাকি বিশ্বাস নেই। জাহিদের সবকথায় ওরা এখন কাফের কাফের গন্ধ পায়। জাহিদ কোন কথা বললেই অন্যকিছুর সন্দেহ করে গ্রামের লোকজন। জাহিদের কথায় যে যুক্তি থাকে সেগুলো যেন তাদের পাথরের চাইয়ের মত বিশ্বাসের উপর আঘাত করে। এইডা কেমন কতা, আল্লায় আমাগো না বানাইলে আমরা আইলাম কুনথিকা, আল্লায় খিলায় দেইকাইতো আমরা খাইতে পারি, বাইচা আছি, হেয় যহন ডাক দিবো তহন কি আর থাকনের উপায় আছে- হের কাছে চইল্যা যাইতে অইবো। চল্লিশটা হাতি দিয়া বাইন্ধা রাখলেই ফিরাইতে পারবো না। আল্লায় বলে নাই-এমুন কতা যে কয় তার উপরে আল্লার গজব নাইমা আহুক। দুই পাতা বই পইড়াই জজ ব্যারিষ্টার অইয়া গেছে গা না--, আল্লার উপর দিয়া কতা কইতে চায়, আল্লাই তো বেবাক কিছু বানাইছে, আর হে এতই যদি পারে তাইলে এডা পিরপা(পিঁপড়া) বানাইয়া দেহাইক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে জাহিদকে তারা মাঝে মঝেই মসজিদে নামাজের সময় সামনের কাতারে দেখতো পেতো। আর এখন হঠাৎ রাত্রিরে তারা দেখতে পায় কে একজন মাটির রাস্তা থেকে মসজিদের দিকে উঠে যাওয়া পাকা সিড়িতে বসে সিগারেট ফুকছে, জোরেশোরে একটা ধমক লাগাবে বা কষে একটা চড়- এমন ভাব নিয়ে কাছে গিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে জাহিদের দুঃখ ভরা মুখ আবিষ্কার করে সেখান থেকে হতচিত্তে সরে আসে। জাহিদকে মাঝে মাঝেই বিষন্ন মুখে চরা ক্ষেতের আলধরে একা একা ঘুরতেও দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বলে তারা সবাই তাকে কিছুটা সমীহ করেও চলে। আর কেউ কেউ অবশ্য অন্য গ্রামে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে জাহিদের কথা বলে গর্বও করে থাকে-আরে মিয়া চিনলা না, আমাগো গ্রামের জাহিদ শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, বিরাট বিদ্ধান ছেলে, মোটা মোটা বই পড়ে, কতকিছু যে জানে! আর এই বছর খানেক হল জাহিদের মাঝে নেতাগোছের একটা ভাবও তারা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করে। জাহিদকে এখন গ্রামের লোকজন আর বুঝতে পারেনা, এখন তাকে তাদের ভিন্ন গ্রহের মানুষ বলে বোধ হয়। সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকা হাবাগোবা এই ছেলেটির আকস্মিক পরিবর্তনে তারা বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে থাকে।

শামীমের মৃত্যু ঘটনাটা যেন জাহিদ চোখের সামনে দেখতে পায়। লোকজনের কাছ থেকে শুনে শুনে ঘটনাটি যেন তার মুখস্থ হয়ে গেছে। শামীম মালকোছা মেরে বাঁশের খুটি থেকে ঝুলে পড়া হাই ভোল্টেজের তারটি ঝিয়াই তার দিয়ে বেঁধে দিতে যাচ্ছে। হাই ভোল্টেজের তারটির উপর দিয়ে প্লাস্টিকের আবরণ থাকার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ অফিসের গাফিলতির কারনেই তারের উপর দিয়ে প্লাস্টিকের আবরন মুড়ে দেয়া হয়নি। এই কারনেই সে মারা গেছে, না হলে সে মারা যেতো না। গ্রামের অশিক্ষিত লোকজনের কথা শুনলে তার পিত্তি জ্বলে যায়, ভিতরে ভিতরে সে রাগে ফেটে পড়ে। আজরাইল এসে নাকি তারের উপর ওঁত পেতে বসে ছিল, যেই শামীম তারে হাত দিয়েছে তখনই আজরাইল তার জান কবজ করে ফেলেছে; এটা কোন কথা হল! কারো নাকি কোন দোষ নেই। শামীমের মৃত্যু ওখানে ওভাবে লেখা ছিল-ওর মৃত্যু নাকি ওভাবেই হবে এটাই নাকি অবধারিত। হায়াত মউতের মালিক নাকি আল্লাহ!- সেখানে কারো কিচ্ছু করার নেই- “স্বপ্নেই নাকি জানান দিয়ে গেছে” এই কথাটা মুখে মুখে বলে বেড়ানো ছাড়া। ওরা যখন মুখে মুখে ছড়া কাটে “যার মৃত্যু যেখানে নাও ভাড়া কইরা যায় সেখানে”। তখন জাহিদের শরীর যেন রক্তশুন্য হয়ে যায়, গাঁয়ের রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠে, চোখে ঘোলা অন্ধকার ঘনিয়ে আসে-যেন তক্ষুনি টাল খেয়ে পড়ে যাবে! যত সব গন্ড মূর্খের দল। এদের জন্যই পুরো দেশটা রসাতলে গেল। নিজেরা তো কিছু বুঝবেইনা আর বুঝদার কথা বলতে গেলেই উল্টো লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে। জাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লে কবেই তাকে সবাই মিলে গ্রাম থেকে বের করে দিত! তার ভাবতে কষ্ট হয়, এদের সাথেই সে একগ্রামে হেসে খেলে বেড়ে উঠেছে। ওর কথা শুনে তারা বলে, তুমি তো আগে এরকম আছিলানা, হঠাৎ কইরা এমন বইদল্যা গেলা কেন? আগে কত বালা আছিলা, নামাজ পড়তা, রোজা রাকতা, মুরুব্বিগো আদব-কায়দা করতা-কলি যুগ আইয়া পড়ছে, ঘোর কলি। এরা কেউ পরিবর্তন সহ্য করতে পারেনা- কারো মাঝেই কোন পরিবর্তন দেখলে তারা ভয় পেয়ে নানা কিছু সন্দেহ করতে থাকে। যে কোন ধরনের পরিবর্তন এদের কাছে অস্বাভাবিক লাগে। সারা জীবন অপরিবর্তি থাকাটাই এদের কাছে স্বাভাবিক। সবকিছু যেন স্থির চিত্রের মত যেমন আছে ঠিক তেমনটিই থাকবে- যেন ক্যামেরায় তোলা ফটো। এই এদের সাথেই ওকে এখনও বসবাস করতে হয়! ভাবতে কষ্ট হয় জাহিদের। সেই সকাল থেকে গ্রামের লোকজনকে সে বোঝানোর চেষ্টা করে আসছে-তারের উপর প্লাষ্টিকের আবরণ না থাকার কারনেই ওর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কোন লাভ নেই-সে ওদেরকে কোনভাবেই বুঝাতে সক্ষম হচ্ছেনা। অথচ সে মনে মনে প্ল্যান করে রেখেছে, এই বিষয়টা নিয়ে সে গ্রামের মোটামুটি সবাইকে সাথে একটা জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলবে কিন্তু বয়স্কদের জন্য সে এগোতে পারছেনা। এই বয়স্করাই তার যেকোন কাজে প্রথম বাঁধা দেয়। গ্রামের তরুনরা যারা এখানে স্কুলে-কলেজে লেখা-পড়া করে তাদের অনেকেই তেমন কিছু না বুঝলেও অবশ্য তার দলেই থাকে সবসময়। কিন্তু তরুনরাও এখন সবাই শোকে কাতর হয়ে আছে। যে মরে গেছে সে তো মরেই গেছে কিন্তু আর কেউ যাতে মারা না যায় সেই ব্যবস্থা যে তাদেরকেই করতে হবে এই খেয়ালটুকু কেন যে তাদের মাথায় আসছেনা!

মামুন বিয়ে করেছে এই কিছুদিন হল- শামীম মারা যাবার দিন পনের আগে পাশের গ্রাম থেকে মাথায় মুকুট পড়ে, ম্যাছতা পড়া নাকটি রুমালে চেপে, সাতটি ট্যাম্পু ভাড়া করে পুতুলের মত দেখতে একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। বরযাত্রীর একজন হিসেবে শামীমও গিয়েছিল সাথে, শামীমের সেদিন সে কি ফুর্তি- সারা শরীরে হাজার পাওয়ারের রঙ মেখে-সঙ সেজে হাসতে হাসতে ফিরেছিল বাড়িতে। পাশাপাশি বাড়ি ওদের- চরা ক্ষেতে ফুটবল খেলে, নদীতে সাতার কেটে, পচা ডোবায় একসাথে মাছ ধরে, বগলে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যেতে যেতে, মারামারি করে, গলাগলি ধরে একসাথেই বড় হয়েছে দুই জন-এবং শামীম বয়সে কিছুটা বড় হলেও তুই তোকারী সম্পর্ক ছিল দুইজনের সাথে। নতুন বিয়ে করা বউয়ের সাথে কম দামী বাল্বের লাল আলোতে দো-চালা ঘরে নড়বড়ে চৌকিতে বিভিন্ন জায়গা দিয়ে তুলো বের হতে থাকা লেপের নিচে শুয়ে এগুলোই ভাবতে থাকে মামুন। বাল্য বন্ধু শামীমের জন্য বুকটা হাহাকার করে উঠে, বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি মনে হতে থাকে। সেই ছোট বেলা থেকে শুরু করে আজকে সকাল পর্যন্ত জমা হওয়া পুঞ্জীভূত স্মৃতিগুলো সিনেমার রুপালী পর্দায় ছবির আলো ফেলার মতোই মনের পর্দায় চলচ্চিত্রের মত একে একে ভেসে উঠতে থাকে। সারাদিনের খাটুনির পরে শরীরে-মনে কিছুটা ক্লান্তিও সে বোধ করে সে। আজকে শরীরের উপর দিয়ে তার অনেক ধকল গেছে- সেই চরা ক্ষেত থেকে শামীমকে উঠিয়ে নিয়ে এসে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া- নাকের ডগায় চশমা ঝুলানো ডাক্তার যাওয়ার সাথে সাথেই মৃত বলে ঘোষণা করলে লাশ নিয়ে গ্রামে ফিরে আসা, কবর খোড়া, বাঁশ কাটা ওদিকে আবার লাশের গোসল করানো, জানাজার জন্য মানুষ ডাকা-ওর বাড়ির লোকজন তো সব কেঁদে কেটেই অস্থির। সেও তো কেঁদে অস্থির হতে পারত ফলে কোন কাজই তাকে করতে হতনা! অবশেষে শামীমকে কবরে শুইয়ে মাটি চাপা দিয়েই কেবল মাত্র কিছুটা গা ঝাড়া দিতে পেরেছে। শামীম কবরে মাটি চাপা যাওয়ার সাথে সাথেই তার মনে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন ভঙ্গীতে গুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে। শামীমের ভঙ্গী কখন ফুটবল খেলার- কখনো মারামারির- কখনো দৌড় ঝাপের- কখনো নদীতে লাফ ঝাপ সাতার কাটার- কখনো নদীতে-ডোবায়-পুকুরে মাছ মারার- বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার- মাঠে লাঙ্গল চষার-ধান কাটার- পেকা ক্ষেতে গোছা গারার। শামীমই ওকে সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছিল। শামীমের সাথে নতুন নতুন সিগারেটে টান দেওয়ার স্মৃতি মনে হতেই তার শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে উঠে। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিয়াশলাইয়ের একখোঁচায় ধরিয়ে ফেলে ঘন ঘন টান দিতে থাকে। স্মৃতির রিলে ফিতায় সে সবশেষে দেখতে পায় শামীমের সাথে খারাপ মেয়েদের পাড়ায় যাওয়ার দৃশ্য। শামীমই তাকে ফুসলিয়ে ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ঐ দিনই সে নারী মাংশের স্বাদ প্রথমবারের মত পায়। হঠাৎ করে আধপোড়া সিগারেটটি হাত থেকে খসে পড়ে কড়কড়ে ঠান্ডা মাটির মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে থাকে। শক্ত তোষকের বিছানায় শরীর ঘষটে ঘষটে এগিয়ে যেতে থাকে বউয়ের দিকে। খালি হয়ে যাওয়া বুকে কি যেন সে পেতে চায়, কিসের অভাব যেন তার বুকে বাজতে থাকে দ্রিম দ্রিম করে। গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে বউকে ঝাপটিয়ে ধরে সে। পেন্সিলের মত সরু ঠোট নেড়ে কেবল কৈশোর কাটানো বউটি অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠে-আপনে কি মানুষ! জ্বলজ্যান্ত লোকটা কারেন্টে ধইরা মইরা গেল-কান্দিতে কান্দিতে আমার চোখ দুইটা ফুইল্যা গেছে। খালি কবরের কথা-কবরের আজাবের কথা মনে পড়তাছে। আর গজবের ফেরেস্তাগো আমি জানি চোখের সামনে দেকতে পাইতাছি। কোথায় একটু দোয়া দরুদ পরবো তা না, আইজকাও! সরেন আপনে-আপনে একটা অমানুষ, আমার শইল ধরবেন না, ছাড়েন কইতাছি, ছারেন অহনি। বউয়ের ভৎসনা পূর্ব রাগের মধুর বকুনির মত মনে হয় মামুনের। তার আজকের আচরনে যেন স্বামীর একঘেয়ে ক্লান্তি নেই আছে মাতাল প্রেমিকের উন্মাদনা। সে তার বউয়ের গলায় ঘাড়ে বুকে ক্ষ্যাপার মত মুখ ঘষতে থাকে। অপর পক্ষ থেকে আসা কঠিন বাঁধা মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে ভেঙ্গে যায়-পাট খড়ির উপর দিয়ে কেউ হেটে গেলে যেমন ভাঙ্গতে থাকে মড়মড় করে। কিছুক্ষনের মধ্যেই পুরুষ মাংশের গন্ধে কাতর হয়ে পড়ে বালিকাটি। ক্ষীণ স্বরে অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ করতে করতে অভ্যর্থনা জানাতে থাকে। কম দামী বাল্বের সুইচটি বন্ধ করার কথাও তাদের কারুরই খেয়াল থাকেনা।

শামীমের বাল্যবন্ধু মামুন যখন বুকে প্রচন্ড শোক নিয়ে ইন্দ্রিয়ের দুর্দান্ত খেলায় মেতে উঠেছে তখন মেশিন ঘরে (চরা ক্ষেতে ইরি ধানে সেচ দেওয়ার কাজে মোটর চালিত গভীর নলকুপ ঘিরে গড়ে উঠা টিনের একচালা ঘর) তাস-জুয়ার আসর জমেছে। এবার শীত যেন বেশ ঝাকিয়ে পড়েছে-কারো গায়ে রোঁয়া ওঠা পুরনো সোয়েটার- কেউ গায়ে চাপিয়েছে ভারী জ্যাকেট, একজনের শীত লাগে একটু বেশী- পুরোনো ছেরা কাথাটা দিয়েই সে নিজেকে আগাগোড়া মুড়ে নিয়েছে, আরেক জন হালকা একটা চাদর গায়ে দিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরটা ভরে গিয়েছে-মনে হচ্ছে এই চারজনের বুক থেকে উঠে আসা শোকের ধোঁয়া যেন। প্রত্যেকে পা মুড়িয়ে বসে বেজার মুখে তাস পিটাচ্ছে- লুঙ্গীর টোনায় খুচরা টাকা দলামলা হয়ে বিভিন্ন দিক থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। এরা সবাই আজকে আস্তে আস্তে কথা বলছে- নিজেদেরকে পুরোমাত্রায় মেলে ধরতে পারছেনা- কোথায় যেন বাঁধছে, কি যেন তাদেরকে আটকে ধরেছে। খুচরা টাকার মত এদের ভেতরের মানুষগুলো বিভিন্ন দিক থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে সরবে বের হবে বলে কিন্তু পেরে উঠছেনা। একজন তাস বাটতে বাটতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললঃ গত কাইল রাইতে শামীম আমাগো লগে এইহানে বইস্যা তাস খেলতাছিল। আর আইজক্যা কই শুইয়া রইছে- আল্লাই জানে, আমাগোও যাইতে অইবো রে যাইতে অইবো, শামীম যেহানে গেছে। ছেড়াডা বালা মানুষ আছিলরে, খুব বালা মানুষ আছিল, এমুন মানুষ পাওয়া যায় না, বালা মানুষ বেশীদিন বাঁচে না! আরেকজন বেটে দেওয়া তাস হাতে নিতে নিতে অস্ফুট কন্ঠে বলেঃ -তয় একটু রগচটা আছিল, যহন তহন রাইগ্যা উঠতো, এই আর কি। কিছু বুঝতে চাইতোনা, গায়ের জোরে হগলকিছু করতে চাইতো, মনে অইতো ধাক্কা দিয়া পাহাড় ফালাইয়া দিবো। মাথাডারে কাজেই লাগাইতো চাইতো না-এজন্যেইতো ভর দুপুরে কারেন্টে ধইরা মইরা গেলো! কামলাগো নগে গেছে প্যাকা ক্ষেতে গোছা গাড়তে, যাইয়া দেহে বাঁশের খুটি থাইক্যা কারেন্টের তার ঝুইলা পড়ছে। বোদাই আর কারে কয়, খালি হাতে গেছে কারেন্টের তার বাঁশের খুটির সাথে বাইন্দা দিতে। কারেন্ট নাই তো কি- যে কোন সোম যে আইয়া পড়তে পারে এই খেয়ালও নাই। এইটুকু বুঝও নাই যে কারেন্ট গেতেই কতক্ষণ আর আইতেই কতক্ষন। যেই তারডা ধরছে অমনি তো কারেন্ট আইয়া পড়ছে। হয় ও ধরার কিছুক্ষণ আগেই আইছে ও টের পায়নাই, কি আর কমু অর কতা। আরেক জন তাস ছাড়তে ছাড়তে বলে-তাস খেলাও ভালো বুঝতো না শামীম। আমাগো লগে তাসের জুয়া খেইল্যা খালি ট্যাহা ক্ষতি দিত। ওর ট্যাহা লাভ কইরাইতো আমাগো সংসার চলতো-বউ পোলাপানরে দুই মুঠা খাওয়াইতে পারতাম। ঐ যে সাদেক যে বিদেশ গেলো শামীমের কাছ থিক্যা ট্যাহা লাভ কইরাইতো গেলো। আগে দেখতিনা সাদেক খালি শামীমের পিছন পিছন ঘুরতো আর সুযোগ পাইলেই অরে নিয়ে জুয়া খেলতে বইতো। এক বাপের এক পোলা আছাল যহন যা চাইতো ওর মায় অরে তাই দিত আর সোম সোম বাপের পকেট থিকাও চুরি করতো। মায়ের আদর পাইয়া লেহাপড়াডাও আর করা অইলো না। ট্যাহা আনত আর জুয়া খেইলা, মদ খাইয়া, ঘরে ডাগর বউ থাকতেও খারাপ পাড়ায় যাইয়া সব উড়াইয়া দিতো। তয় দিল দরিয়া আছিল- কত মাইনষেরে যে কত ট্যাহা কর্জ দিত তার কোন ঠিকানা নাই। যে ছেলেটা হালকা একটা চাদর গায়ে দিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসেছিল সে একটু নড়েচড়ে উঠলো। হঠাৎ করে কি যেন তার মনে পড়ে গেল, সে তার পাশের জনকে একটু ধাক্কা দিয়ে বললঃ হোনই একটা কথা কই, কাউরে কইস না কিন্তু বলাডা জানি ঠিক না কিন্তু না বইলা ঠিক থাকতে পারতাছিনা, বুকের ভেতর খালি মোচড় পারতাছে। মাসেকখানি আগে আমিও শামীমের কাছ থিকা কিছু ট্যাহা কর্জ করছিলাম, কেউই অবশ্য জানেনা(ফিসফিস করে), পরশু দিনও আমারে জিগাইছিল ট্যাহার কতা, আমি কইছি- আর সপ্তা খানিক সবুর কর ঠিক দিয়া দিমু। এহন তো ও মইরাই গেছে, ট্যাহাডা মনে অয় আর দিতে অইবো না। অর ট্যাহার চিন্তায় রাইতে বালা ঘুম অইতো না। তগো বিশ্বাস কইরা কইলাম, কাউরেই কইসনা কিন্তু অর বাপ-মায় জানি না জানে। ওর বাপে যে লোক হুনলে চাইতেও পারে, না চাইব না মনে অয়। একটা পোলা আছাল হেই মইরা গেছে, তার কর্জ দেওয়া ট্যাহা চাইব না মনে অয়। দেক তোরা কিন্তু কইস না কাউরে, তগো খোদার দোহাই। কাঁথা গায়ে দেওয়া লোকটি খোঁচা মেরে বলে, আজকে মনে অয় তর বালা ঘুম অইবোরে।

লেপের তলায় কাচুমুচু হয়ে শুয়ে থাকা ফজলু মিয়ার কানে হালকা একটা পাখির পালকের মত ঢোকে- আসসালাতু—খাইরুম—মিনান-- নউম—আসসালাতু—খাইরুম—মিনান—নউম--। সে আড়মোড়া দিয়ে পাশ ফিরে অন্ধকারের মধ্যেই তার বউয়ের বলীরেখা আঁকা মুখ অনেকটা স্পষ্ট দেখতে পায় যেন। বউয়ের থলথলে হয়ে যাওয়া শরীরে তার হাতের স্পর্শ লাগতেই বিবমিষা জাগে। অন্ধকারে হাতড়ে বেড সুইচে চাপ দিতেই সাদা ঝকঝকে আলোয় তার ঘর ভরে যায়। লেপের তলা থেকে কোনমতে নিজেকে টেনে উঠিয়ে খাটে বসে পায়ে স্যান্ডেল গলাতে গলাতে তার চোখ পড়ে হালকা নীল রঙের তরতাজা ফ্রীজটির উপর। ফ্রীজটি যেন নীল শাড়ির ঘোমটা টানা মুখে নতুন বউয়ের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে কাছে গিয়ে ফ্রিজের গায়ে হাত বুলাতে থাকে পরম আদরে। ফুলশয্যার রাতের মত ফ্রীজটিকে তার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। ফ্রীজের পিছনদিক থেকে বের হয়ে আসা একটা শব্দের রেশ তার কানে মিষ্টি মধুর গানের কলি হয়ে প্রবেশ করে। আবেশে নতুন বউয়ের নরম হাত শক্ত মুঠিতে চেপে ধরার মত সে ফ্রীজের হাতলটি ধরে টান দিয়ে ঢাকনাটা খুলে ফেলে। ফ্রীজে থরে থরে সাজানো কোরবানীর ঈদে জবাই করা লাল ষাড়টির মাংশ। মাংশ থেকে উঠে আসা বাষ্পীয় ধোঁয়া তাকে মেঘলোকের দেশে নিয়ে যায়। সাদা তুলোর মত মেঘগুলো যেন তার চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভেতরের স্তুপাকার মাংশগুলোকে নতুন বউয়ের ফুলে উঠা পেটে তার ঔরসজাত অভূমিষ্ঠ সন্তানের মতই মনে হয়। ত্রিশ বছর আগে বিয়ে করেছে সে- এত দিনেও সে তার বউয়ের পেটে কোন সন্তান রাখতে সমর্থ হয়নি। কয়েকবছর আগ পর্যন্তও তার আশা ছিল কিন্তু ডাক্তার যখন শেষবারের মত বলে দিল সমস্যা নাকি তারই, সে একশো একটা বিয়ে করলেও নাকি তার সন্তান হবেনা। বউয়ের সমস্যা থাকলে না হয় সে আরেকটা বিয়ে করে ফেলত কিন্তু এখন সে তো তার বউকে আরেকজনের কাছে পাঠাতে পারেনা! তারপর সে ফ্রীজের নিচের ঢাকনাটি খুলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়- যাক এখানে তাহলে কিছুটা জায়গা খালি আছে। সে খুব ভেবে চিন্তেই বেশ বড় একটা ফ্রীজ কিনেছে, টাকা যদিও একটু বেশী লেগেছে! কত কাজেই তো লাগতে পারে- সে কথা কি আর আগে থেকে ভেবে রাখা যায়। যত বেশী জমিয়ে রাখা যায় ততই ভালো। আজকেও তো কিছু জমাতে হবে-রেখে রেখে খেতে হবে। নিয়ে আসা যায় একবারে অনেক কিছু কিন্তু একবারে তো আর সব খেয়ে শেষ করে ফেলা যায় না, খেতে হয় ধীরে ধীরে।

আজকে শামীমের মৃত্যুর তিনদিন হলো-শামীমের বাবা কিছুদিন পরে করতে চেয়েছিল অবশ্য। এই ফজলু মিয়াইতো(বুকটা ইঞ্চি দুয়েক ফুলে উঠে) তাকে তাড়া দিয়ে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে আজকের দিনটাই ঠিক করেছে। দেরী করে কী লাভ বল, করতে যখন হবেই তাড়াতাড়িই করে ফেলাই তো ভালো। মরার খরচের কাজটা করে ফেললেই তোমার ছেলে কবরে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। আর করবে যেহেতু বেশ বড় করেই করো না কেন; সারা গ্রামের লোকজন খাবে, তোমার আত্মীয়স্বজনও তো কম নয়, তাই না? পেট পুরে খেয়ে দেয়ে যেন সবাই প্রাণ খুলে তোমার মরা ছেলের রুহুর জন্য দোয়া করতে পারে, সেই ব্যাবস্থা করতে না পারলে আর খরচ করা কেন! আর গ্রামে তোমার মর্যাদার কথাও তো তোমাকেই ভাবতে হবে, অন্যে তো আর সেটা ভেবে দিয়ে যাবেনা। ছোট করে করলে এলাকার লোকজন কি ভাববে বলতো? সবকিছুই তো খেয়াল রাখতে হয়। তুমি তো আর যেই সেই মানুষ নও। কি বলছো, টাকায় টান পড়বে, আরে কি যে বলো তুমি, আমি থাকতে ও কথা একদম মুখে এনো না। দু-জোড়া বলদ আর দুইটা মোটা সোটা খাসি হলেই তো তোমার চলে যাবে, নাকি বল? টাকা তুমি দিও যখন পার, আসল টাকাটা তাড়াতাড়ি দিতে না পারলে শুধু মাসে মাসে কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে গেলেই চলবে। আরে সুদ বলছো কি, সুদ হবে কেনো, ছি-ছি-ছি কি যে বলো তুমি!সুদের কারবার আমি করিনা, মানুষের বিপদ দেখলে পাশে গিয়ে দাড়াই। সেও যাতে আমার পাশে থাকে সবসময়। আমি তোমার বিপদ দেখলাম আর মাসে মাসে আমার বিপদ হলে সেটা একটু দেখবে, এই আর কি। মাতব্বর মানুষ তোমাদের সেবাযত্ন করেই দিন কেটে যায়। তোমাদের মত গায়ে খেটে তো আর উপার্জন করতে পারিনা। আরে- না—না- কি যে বলো তুমি, তোমার মাথা দেখি একবারে গিয়েছে বেশী রাখবো কেনো, তোমার বিপদের সময়, অন্যদের কাছ থেকে যা রাখি তার চেয়ে কিছু কমই রাখবো- ও নিয়ে তুমি একদম চিন্তা করোনা। টাকা তো আমার ঘরেই পড়ে থাকতো তাই না! আর আয়োজনের জন্য যে লোকজন লাগবে সেটা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা, হাসালে আমাকে বড়! আমার লোক সব থাকবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, আর আমিও থাকবো সেই সকাল বেলায় গরু জবাই থেকে একেবারে পাতা ফেলা পর্যন্ত। ওরা তো আর টাকা পয়সা চাইতে আসবেনা তোমার কাছে, আর তার দরকারও নেই। শুধু দাওয়াত শেষে যদি কিছু মাংশ দই বেশী হয় সেখান থেকে কিছু দিয়ে দিলেই চলবে। আর সেটা নিয়েও তোমাকে ভাবতে হবে না- বারা খোরা তো সব ওরাই করবে, ওদেরটা ওরাই ভালো বুঝে নেবে। ফজলু মিয়া বলতে বলতে হঠাৎ করে অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেলেছিল, জানো তো আমি একটা বেশ বড় একটা ফ্রীজ কিনে ফেলেছি, কোরবানীর মাংশ রাখার পরও ঢের জায়গা এখনো বাকী আছে।

পুরো গ্রাম উৎসবে মেতে উঠেছে। সবাই দল বেঁধে ছুটে আসছে শামীমদের বাড়ির দিকে, গ্রামের কারো বাড়িতেই আজ দুপুর বেলা হাড়ি চড়েনি। দাওয়াত বাড়ীর চারপাশে কুকুর গুলো বিরতিহীন ঘেউ ঘেউ করছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা হাঠৎ হঠাৎ দু একটি মোটাতাজা কুকুরকে গরুর লম্বা লম্বা হাড় নিয়ে দৌড়ে যেতে দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠে। হাড়জিরজিরে কিছু কুকুর ও বিড়ালকে ঘেঁষাঘেঁষি করে কলার পাতায় লোকজনের রেখে যাওয়া ছড়ানো ছিটানো কিছু ভাত, মাংশের ঝোল, ঘোল দই চেটে চেটে খেতে দেখে দুই একটি ছেলে ছোকরা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। সারা দিন না খেতে পাওয়া ছাগলগুলোর ভ্যা ভ্যা করে ডাকে- নাভীর নিচে গোজ দিয়ে শাড়ি পড়া সদ্য গজে উঠা তরুনীদের কান ঝালাপালা হয়। ওরা তো আর গরুর হাড় চিবিয়ে খেতে জানেনা, দু একটি ছাগল ঘুরে ঘুরে নীরস কলা পাতা চিবায়। কাকগুলো বাড়ীর উপরে উড়ে উড়ে পাকদিয়ে চলেছে, তাদের কা-কা শব্দ ভদ্রলোকদের বিরক্তির মাত্রা বাড়িয়ে চলে-ছোটলোকদের ভাত, তরকারী, ডাল চেয়ে চিল্লাচিল্লিতে এমনিতেই তারা যারপরনাই বিরক্ত। গরু মারার খবর পেয়ে কয়েকটি শকুনও এসে জুটেছে। সেই সকাল থেকে তারা বাড়ীর পাশেই চরাক্ষেতে চুপচাপ বসে আছে। মাঝে মাঝে শুধু দু-একটির ডানা ঝাপটানির আওয়াজ পেয়ে গ্রামের মুরুব্বীরা মনে মনে ঘোরতর অমঙ্গলের আশংকা করতে থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন