কবিতার পরিবারের একমাত্র ব্লগজিন

এখনও পর্যন্ত  Website counter  জন ব্লগটি দেখেছেন।

শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৩

গল্প - সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

নিভৃতে যতনে
সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়



এই কাহিনীতে “প্রথমে মোহাবেশে, বর্ণ বৈচিত্রে প্রেমের বন্ধন তারপরেই সহজ সত্যের স্ব স্ব সালংকৃ্ত মহিমায় প্রবুদ্ধ মনের কাছে তার পূর্ণ বিকাশ।”


****

সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে আছে সব চেয়ে উঁচু টিলাটাতে। আর প্রকৃ্তির পেয়েলায় চুমুক দিয়ে দেখছে বাইরে-

শীত একটু একটু করে ঝুলি নিয়ে আসতে শুরু করেছে। পাহাড়ের মাথায় জল ভরা মেঘের ভাঁড়। উঁচু উঁচু পাহাড়্গুলোর ছায়ারা গাড় রঙের সাজে লম্বা হতে হতে আঁধারের রূপ নিয়েছে। উপত্যকার পায়ের নূপুরে একটু একটু করে শিশিরের রিনিঝিনি জমতে শুরু করেছে। প্রকৃ্তির ছেনির কাজ না দেখলে রসগ্রহণ করা যায় না।

এমনি এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থ অবাক হয়ে প্রকৃ্তিকে দেখছে। পঁচিশটা বসন্তের আগেও যে দেখেনি তা নয়, তবে এ পাহাড় যেন এক নেশার পাহাড়। অদ্ভুত এক সন্মোহনী পাহাড়কল্প। চারিপাশে সবুজের ঘনঘটা। তির তির করে বয়ে চলেছে শান্ত নদী বিয়াস। অসংখ্য হট স্প্রিং। মাঝে মাঝে উপজাতিদের বাঁশ আর কাঠের তৈ্রী ঘর, ঠিক যেন পটে আঁকা ছবি। প্রকৃ্তির দৌ্রাত্ম পাহাড়ের গায়ে আদিম সৃষ্টির রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। এই উদ্ধত ছবি যে কোন প্রকৃ্তি প্রেমিককে বাঁধতে পারে আস্টে পিস্টে। এইসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে সিদ্ধার্থ হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে আর শুনতে পায় খিল খিল হাসির শব্দ -

“ ও বাবু ক্যয়া পথ হারাছি নাকি, পথ দেখি না চলছ্”- নারী কণ্ঠস্বর যেন আরো কাছে এসে বললঃ -“এ শুনসান পাহাড়ে তু একেলা ক্যা করছ্”-

ও ভূত দেখছে না তো। সামনে দাঁড়িয়ে এক মূর্তি, খালি ঠোঁট নড়ছে তার। গোলগাল চেহারা, চাপা নাক, আঁটোসাঁটো গড়ন, টলটলে চোখে বাঁকা ভুরু। এক পিঠ কোঁকড়ানো চুলের একটা দুটো চলে এসেছে অজান্তে ওর গোলাপী গালের ওপর। ফারসাহী রংয়ের আঁকিবুঁকি লুঙ্গি। আর তার সাথে জলপাই রঙ্গের জামাবন্ধ। রূপোর কানের দুল কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে গেছে। মাথায় টায়রা কপাল জুড়ে। একটা লম্বা গোলাপী রঙ্গের উড়নি দিয়ে মাথাটা ঢাকা। কোমরে বাঁধা রূপোর চন্দ্রহার। সিঁদুরে মেঘে কি যেন এক মোহিনী মূর্তি এঁকে দিয়েছে বিচিত্র মোলায়েম ছবি।

দূরে কোথাও মন্দিরে তখন গুরুগম্ভীর স্বরে বেজে চলেছে-

বুদ্ধং শরনং গচ্ছামি।

ধর্মং শরনং গচ্ছামি।।

সঙ্ঘং শরনং গচ্ছামি।।।

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, একেই কি বলে “লাভ এ্যট ফার্স্ট সাইট”- শেষে নিজের স্তম্বিত ফিরে পেয়ে বললঃ

-আমি সিদ্ধার্থ। এখানে প্রথম বেড়াতে এসেছি।

-'সিধা' বলেই এক খিল খিল হাসি ছড়িয়ে চলে যাচ্ছিল-

জিগেস করলাম,- “তোমার নাম কি?”

-'পিংকাঙ' এখানেই থাকি। বলেই, না দাঁড়িয়ে পাহাড়ী ঝর্নার মতন এঁকেবেঁকে মিলিয়ে গেলো সবুজ ঘন আঁধারে। মাথার উড়নিটা হাওয়ায় ভেসে ভেসে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল যেন ওকে পেছন পেছন আসতে বলছে। ওর মিসটি হাসির প্রতিধ্ব্নি কানে এসে ঢুকল।

ভাবল তাই তো, হিমাচলেই তো কিন্নর দেশ। অনেক মেয়ে দেখেছে - কিন্তু এই মেয়ে যেন মনে শিস্ বাজিয়ে গেল।

একটা উঁচু টিলায় বাড়ী ভাড়া করেছিল সিদ্ধার্থ। চারিদিকে আপেল বাগান আর লাল, কমলা, হলুদ, বেগুনী ফুলের সমারোহ। বারান্দায় বসে আছে আর দেখছিল কেমন করে প্রকৃ্তির রূপ পান করছিল এক সুন্দর শান্ত সকাল। সোনালী নরম রোদ আপেল গাছের ছায়াদের গায়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। নির্জ্জন সময়ে গাছে ওদের সৌন্দর্য বিলিয়ে দেয়। মানুষ না দেখলেও ওদের বয়ে গেছে। আবার চোখ চলে গেল সেই কালকের সবুজ পাহাড়ে কিন্তু একি সেই পাহাড়ী মেয়েটার কথা কেন আবার মনে এল। একটা লাল পাখি শিমূল গাছটায় ডেকে উঠল। মনে হল...সেও বলছে “মনের মেয়ে...মনের মেয়ে”। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দেখে সেই-ই কালকের পিংকাঙ আর তার সাথে আরেকটা পাহাড়ী মেয়ে।

আশ্চর্য! নামটাও মনে আছে তার। একবার শুনেই কি ভাবে মনে রাখল? ওরা ওই ফুল কুড়োচ্ছিল আর লাল আপেল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল সিদ্ধার্থ। গুটি গুটি পায়ে ওদের কাছে এল।

-আবার তোমার সাথে দেখা হল, পিংকাঙ।

চমকে উঠল পিংকাঙ পরক্ষণেই সুস্মিত হাসিতে গালে টোল ফেলে লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে উঠল। অপরূপ লাগছিল ওর মিসটি সুন্দর মুখশ্রী। চোখ না তুলেই আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, অস্পষ্ট শুদ্ধ বাংলায়।

-আমার বন্ধু কামপা, হমার ছোট্ট বেলার সাথী।

-কামপা, এই সেই সিধা... পা হররকে নীচে তলিয়ে যাইচ্ছিল কাল।

-ওহ্! মেয়ে মুচকি হেসে তাকাল সিদ্ধার্থর দিকে।

-এত ফুল আর আপেল দিয়ে কি করবে তোমরা?” ভর্তি সাজির দিকে ইংগিত করল, সিদ্ধার্থ।

-মালা গেঁথে আমার সিধার গলায় পরাব গো। আর আপেল...!-বলেই, দুই সখী অদ্ভুত হাসিতে ভেঙ্গে পরল। ওদের হাসিতে মনটায় প্রেমের জোয়ারে্র ধাক্কা খেল। ওরা বুদ্ধকে সিধাও বলে দেখছি।

এমনি সব হাসি ঠাট্টা করতে করতে ওরা যে কখন সিধ-এর কাছে এসে গেছিল, জানেনা। বোধকরি সিদ্ধার্থ নিজেও না।

ওদের সাথে ফুল কুড়াল, আপেল গাছে যে কেউ হাত দিতে পারে না সেটাও জানতে পারল ওদের কাছ থেকেই। আপেল তোলার সময় যদি গাছের পাতাও ছিঁড়ে যায় তাহলে, পরের বছর আর সেই যায়গায় আপেল হয় না, তাই খুব সাবধানে ছুঁতে হয় আপেল গাছকে।

সিদ্ধার্থ শুনে মনে মনে ভাবছে... ঠিক তোমার মতন করে সাবধানে ছুঁতে হয় পিংকাঙ।

পাহাড়ে পাহাড়ে ছুটোছুটি করল, পাহাড়ের গায়ে নিজেদের নাম লিখল, ভগবান বুদ্ধের মন্দিরে গেল, শান্ত কল্পার বুকে নৌকোয় ঘুরে বেড়াল।

ওদের সাথে যত মিশছে, তত পাহাড়ীদের সম্পর্কে ওর ভালবাসা বেড়ে যাচ্ছে। এদের কি সুন্দর সমাজ, ধর্ম, জীবন-যাপনীর রীতি সব কিছুকেই যেন ও ভালবেসে ফেলেছে। কচি নিষ্পাপ এদের মুখগুলো। আপন করে নেওয়া এক দুর্দ্দাম আকর্ষণ।

মনটায় যেন কি সব হয়ে চলেছে। ঠিক সেই হিন্দী মুভিটার মতনঃ “ কুছ কুছ হোতা হ্যায়”- টাইপের। অদ্ভুত লাগছে।

এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কামরুনাগের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চূড়োয় দাঁড়িয়ে আছে সিদ্ধার্থ আর পিংকাঙ। ওপরে ওঠার সময়ে একবার ওর ঠান্ডা নরম হাতটা ধরতে হয়েছিল।

খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে দুজনেই ক্লান্ত। পড়ন্ত বিকেলের সিঁদূরে আলো দূর পাহাড়ের গায়ে ছিটকে পড়ে কেমন বিষণ্ণ আর রহস্যময় করে তুলেছে পরিবেশটাকে। মন খারাপ হয়ে যায় পিংকাঙ-এর । উদাস ভাবে কাঁপা গলায় বলে-

-তুমি কোথায় থাইকো? কইবে ফিইরে যাবে... মুখ নামিয়ে বলল-বেশিদিন থাইকলে কিন্তু নেশা হইয়ে যাবে। এ পাহাড়ী বনাঞ্চল বড় রহস্যময়ী। বন মানুষকে আকর্ষণ করে। এ মায়ায় বেঁধে পরলে আর ফিরে যেতে পাইরবে না।

-বন মানুষকে আকর্ষণ করে কিনা জানি না, কিন্তু বনরূপার আকর্ষণতো সাংঘাতিক দেখছি। অনেকটা মুখ ফসকেই বলে ফেলে কথাটা।

মূহুর্তেই ভালবাসার রঙ্গিন প্রজাপতিগুলো পিংকাঙের চঞ্চল চোখে নেচে বেড়াতে দেখল... সিদ্ধার্থ। এ কোন মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে ও জানে না। একটা পাহাড়ী মিসটি মেয়ের না উদ্দাম প্রকৃ্তির? নিজেকে প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পেল না। শুধু একঘেয়ে ছন্দহীণ জীবনবীণায় এক অজানা সুরই শুনতে পাচ্ছে।

-সিধা কাল আমাদের বড় পরব আইছে। তুম আয়েছা দেখিনা ক্যা ভনছা' -

বলে কুমারী মেয়ের চিরন্তন অকারণ হাসি ছড়িয়ে পাহাড়ী ঢালু বেয়ে প্রায় নেচে নেচেই নেমে গেল পিংকাঙ। আর রেখে গেল এক অজানা সুর এক অজানা প্রেমের লয়। ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে কোথাও যেন উধাও হল সিদ্ধার্থ। কেউ তো এমন ভাবে মন-কে নাড়া দেয় নি? তাহলে......?

পাহাড়ী পথ বেয়ে নামতে নামতে ভাবছে সিদ্ধার্থ-কি অদ্ভুত! এ কটা দিন কি ভাবে যে কেটে গেল টেরই পায়নি। নতুন কাজে ঢোকার পর প্রথম ছুটিতে বেড়াতে এসেছে এই হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ী এলাকায়। একা... একদম... একা। কাছ থেকে নদী-সমুদ্র ও সবুজ পাহাড়ী বনাঞ্চল দেখবে বলে। সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ফিরে যেতে হবে এবার। আবার সেই একঘেয়ে গতানুগতিক জীবন। ভাবতেই অজানা বিচ্ছেদের আশঙ্কায় ছেয়ে যাচ্ছে মন। তবুও তো ফিরে যেতেই হবে। কিন্তু পিংকাঙ? ওকে ছেড়ে? ওর নরম মনটাকে কি ও আঘাত দিতে পারবে? ওকে দেখে যে শরীরে এক উদ্দাল নাচন শুরু হয়েছে সে কি আর কেউ দিতে পারবে? এরকম নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হল সিদ্ধার্থ।

দুই সখী সুন্দরভাবে সেজে বিকেলে রেকংপিতে এসে হাজির হয়েছে। কাঠের সিঁড়ি। আর কাঠের তৈ্রী মাচার ওপর টিনের ছাউনি দেয়া প্যাগোটা। আজ রাতেই বুদ্ধপূর্ণিমা। বুদ্ধের জন্মতিথি। সারা মন্দিরে ঘিরে বিরাট উৎসব। নানান মেলা শুরু হয়েছে। সে এক এলাহি কান্ড। পাহাড়ী জাতের কেউই বোধহয় বাকি নেই। সুসজ্জিত নানা পোশাকের মেয়ে-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো দলে দলে এসে হাজির হয়েছে। সারাদিন কোন কাজেই মন বসাতে পারেনি পিংকাঙ। আর সিদ্ধার্থ? চোখে মুখে রাতজাগার চিহ্ন। এতবড় উৎসবের আনন্দ ওদের মনকে ছুঁতে পারছে না।

সিধা! আর সিধা! তার বড় বড় চোখ সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। সিধাকে ভালবাসি ভাবতেই পিংকাঙের বুকের কাঁপন অহরহ বেজে চলেছে।

সামনে এসে দাঁড়ায় প্রচলিত রীতিনীতির অদৃশ্য শক্ত প্রাচীর। কামপা সখীর দুঃখ বুঝতে পারছে। কিন্তু সমর্থন করবে কি ভাবে? সামনে যে বিরাট বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে সখীর মিলন অসম্ভব-তাই বোঝাচ্ছে বন্ধুকেঃ

-পিঙ্কি, রোও না মত। তু ভুল যেইছ শকতি। মন্দিরে যা। মনজ শান্তি আয়েগা। আমরা পাহাড়ী আর তোর সিধা শহুরী।

আকাশে পূর্ণিমার বিশাল চাঁদ। যেন আলোর শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। বিয়াসের নিস্তরঙ্গ জলে চাঁদের ছায়া। বিয়াস তো নয় যেন তিয়াসা... যেন তৃষ্ণা। বিপাশা থেকে বিয়াস নামটা এসেছে। দূরে পাহাড় বনরাজি। আর মন্দিরে পাহাড়ী নর-নারীর হাস্য মুখরিত কোলাহল। সব মিলিয়ে অদ্ভুত পরিবেশ। মন্দিরটা বেশ উঁচু যায়গায়। পাহাড়ের টিলার ওপর। অনেক নাগেশ্বর গাছের ছায়ায় আবৃত। চারিদিক ফুলের মিসটি গন্ধে ভরপুর।

একটু পরেই শুরু হবে পাহাড়ীদের প্রিয় অনুষ্ঠান। রং জল আর আবীর রং খেলা। এতো যৌবনেরই উৎসব।

রবিঠাকুর বোধহয় এখানে বেড়াতে এসেই লিখেছিলেনঃ

“আমরা অদ্ভুত, আমরা চঞ্চল …

আ......মরা...আ..।।

নূতন যৌবনেরি দূত!!”

আর সবার মতো অদ্ভুত সুন্দর গোলাপী সাজে পিংকাঙ, সাদা পাজামা আর লাল রঙের পাঞ্জাবী সাজে সিদ্ধার্থ, ও তার সুবেশি সখীরাও অপেক্ষা করছে গভীর আগ্রহে।

মন্দিরের সামনে বাঁশ দিয়ে খানিকটা যায়গা ঘিরে দেওয়া হয়েছে। লাল, নীল, বেগুনী, সবুজ, কমলা, হলুদ বেলুন আর পতাকায় সাজানো মন্দির। বেশ কয়েকটা ড্রামে রঙিন জল আর এক পাশে ঢাঁই করা নানা রঙের আবীর। সামনে ঢোল-বাঁশির উল্লাস ধ্বনি দিতে দিতে আর গান গাইতে গাইতে নানাবেশি যুবক যুবতীদের একটা হাস্যোজ্জ্বল মিছিল উঠে আসছে এই ঘেরা যায়গায়।

-”চেংবা হুই চেংবা

ঢাম্পুলে আজা ক্যায়া ভন ছা-”

সিদ্ধার্থ ছোটবেলায় একটা হিন্দী সিনেমায় এরকম ঠিক দেখেছিল। এই মূহুর্ত্তে নামটা মনে করতে পারছে না। তিনদিন ধরে চলে এই উৎসব। এরই মাঝে ছেলেমেয়েদের জানাশুনা হয়। হয় মন দেয়া-নেয়া। কথা পাকাপাকি হয়। তারপর রঙিন জল ছিটিয়ে বরণ করে নেয় জীবন সাথিকে। মন্দির তো আছেই। আর আছে কামিনী ফুল।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওরা দেখছে কিভাবে ভালোবাসার লাল পাখীরা পাহাড়ী খরস্রোতা নদীর মত তরুণ-তরুণীদের চোখে চোখে নেচে ফিরছে। অকারণে ওরা হেসে উঠছে। সিধার বুক পিংকাঙের জন্য ছটফট করছে।

রঙিন জল খেলা দেখতে দেখতে আর রঙিন স্বপ্নে ওরা দুজন অনেকটা নিজের অজান্তেই কামিনী গাছগুলোর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সিধা একটু ঘনিষ্ট হতে চাইলো... ভাবছিল... একটু যদি ওর নরম শরীরটাকে নিজের শক্ত বুকে চেপে রাখা যেতো-ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কোনদিন তো কোন মেয়ের সান্নিধ্যে আসেনি বা আসবার সময় পায় নি। নিজের কেরিয়ার নিয়েই ব্যাস্ত থাকতে হয়েছে।

পিংকাঙ-এর কথায় আবার স্তম্বিত ফিরে পেল-' ক্যায়া দেইখছ'- অনেক কষ্টে ওর নরম হাতটা ধরল। হাতে একটা উষ্ণ চুম্বন এঁকে দিল। লজ্জায় রাঙ্গা পিংকাঙ কেঁপে উঠল। কেউ নেই চারপাশে। কিন্তু একটা দূরত্ব যেন গ্রাস করল দুজনকে। শান্ত হয়ে পিংকাঙ মিস্টি গলায় বললঃ

-সিধা, আমি যদি জল্ রং ছিটিয়ে দিয়ে আবিরে তোমার পোশাক রঙিন করে দি?

সিধা চোখ মেরে বললঃ “আর আমি যদি না দিই পিংকাঙ। কি হবে তখন?”

সিদ্ধার্থ জানে এই পাহাড়ী দেশের মেয়েদের বিয়ে করলে অনেক বিপদ আছে তাই পিংকাঙের কালো গভীর চোখে চোখ রেখে অনেক কষ্টে উচ্চারণ নেগেটিভ উত্তর করল সিদ্ধার্থ। পরমূহুর্ত্তেই ওর গায়ে ছিটিয়ে দিল রঙিন জল।

“তোমাকে আমি ভুইলতে পাইরব না সিধা”... বলেই আঠারো বছরের পাহাড়ী তরুণীর চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল স্ব্প্নভাঙ্গা জলের টিপ টিপ ফোঁটা। তারপর কি ভেবে বুকের আড়াল থেকে শকুন্ত পাখীর চিকণ পালক বের করে সিধার হাতে দিয়ে বললঃ

-সিধা, লাল বসন্তের শকুন্ত পাখীর নাম শুনেছ? চোখের সামনে সুখ বিলোয়। ভালবাসার ছোঁয়া লাগিয়ে মনে আগুন জ্বালায়। তারপর রেখে যায় বাঁধনের দড়ি কষে। প্রবাদ আছে- ভালবাসার কাঙাল হয়ে যারা মরে তারা নাকি শকুন্ত পাখী হয়।

সিধা পালক আমার কথা তোমাকে মনে করিয়ে দেবে নিশ্চয়ই। আমার অন্তরের সুখের স্পর্শ তোমাকে দিলাম। এ শকুন্ত পাখীর পালক হারিয়ো না কখনো।

হঠাৎ করেই নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এল ওদের মাঝে। অল্প দিনে কি যাদুতে বাধা পড়ল দুটি হৃদয়। কোন এক অজানা শিহরন খেলছে পিংকাঙের স্বপ্নের সাথি সিধার শরীরেও। মনে মনে সিদ্ধার্থ ভাবছে আর হয়ত ফেরা অসম্ভব।

কামিনী গাছের ছায়ায় ওকে জড়িয়ে ওর কাঁপা ঠোঁটে এঁকে দিল ওর ভালবাসার চিহ্ন। অনেকক্ষণ ধরে ওরা আষ্টেপৃষ্টে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে রইল, হঠাৎ একটা পাতা পরে ওদের ভালবাসার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। পিংকাঙ-এর দিকে তাকিয়ে সিধ মনে মনে গাইলঃ

-“ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে

আমারি নামটি লিখো তোমার মনেরো মন্দিরে”- পিংকাঙ-এর মাথায় নিজের হাতে ওর কাঁধে রাখা লাল চাদরটা দিয়ে একটা ফটো তুলে নিল। মাকে গিয়ে দেখাবে ওর আদরের ছোট্ট পাহাড়ী পুতুল।

ঐ পুতুল সিদ্ধার্থ হাতছাড়া করতে পারবে না কিছুতেই। মনে মনে ঠিক করল সব বাধাকে ডিঙিয়ে তার পাহাড়ী পুতুলকে চাই-ই-চাই। নিজের মা -বাবার দিক থেকে কোন বাধা আসবে না, কারণ, তারা জানেন ছেলের ভালবাসা অহেতুক না। বাধা আসতে পারে পিংকাঙ-এর দিক থেকে। তার মন বলছে, সে বাধাও হার মেনে যাবে তাদের ভালবাসার কাছে। ওর বাবা মা তো সরলভাবে অনেক ভালবেসেছে পিংকাঙের 'সিধা'-কে। মনে একটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল যখন... মন্দির থেকে গুরু গম্ভীর সুর ভেসে আসছে তখনও-

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।

ধর্মং শরণং গচ্ছাম।।

সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি।।।

******************

এই গল্পের সমাপ্তি নাহয় ন্যস্ত রইল পাঠক -পাঠিকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে।

৩টি মন্তব্য:

  1. খুব ভালো লেগেছে গল্প । আরও পড়বার আগ্রহ জন্মালো।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ রইল, আরো লেখার আগ্রহ জন্মালো। সাথে থাকুন।

      মুছুন
  2. এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এতো যৌবনেরই উৎসব।
    কামরুনাগের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চূড়োয় দাঁড়িয়ে আছে সিদ্ধার্থ আর পিংকাঙ। নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এল ওদের মাঝে। অল্প দিনে কি যাদুতে বাধা পড়ল দুটি হৃদয়। সব বাধাকে ডিঙিয়ে তার পাহাড়ী পুতুলকে চাই-ই-চাই। আমার অন্তরের সুখের স্পর্শ তোমাকে দিলাম।

    উত্তরমুছুন